ক্যাটাগরি

ইফতার: চকের ‘ঐতিহ্য’ এখন ‘মৌসুমিদের’ কব্জায়

স্থানীয় বাসিন্দা, ইফতারের দোকানি এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে বিচিত্র সব খাবারের সঙ্গে কেবল বিভিন্ন বাবুর্চির নাম জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তার সঙ্গে ঐতিহ্যের কোনো পরম্পরা নেই।

রমজানে ইফতার বিক্রিতে লাভ বেশি বলে অন্য কাজ ছেড়ে অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে নানা ধরনের খাবার তৈরি কিংবা বিক্রির কাজে যোগ দেন বিভিন্ন পেশার মানুষ।

বছরের বাকি সময় তাদের কেউ চা বিক্রি করেন, কেউ বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী, কেউ বেকার থাকেন, কেউবা বিক্রি করেন মুরালি! তাদের অনেকের কাছে জানতে চেয়েও উত্তর মেলেনি কীভাবে তৈরি করেন কোন খাবার।

চকবাজারের শাহী মসজিদের উত্তর পূর্ব কোণে মাঠা নিয়ে বসে ছিলেন এক যুবক। কার মাঠা জানতে চাইলে বললেন, ‘নিমাইয়ের মাঠা’। আপনি কেন বিক্রি করছেন সে প্রশ্নের জবাবে মিলল তার মৌসুমি পরিচয়।

“ইসলামপুরে মাল টানার কাজ করি। রোজার মাসে নিমাইয়ের কাছ থেকে মাঠা এনে বিক্রি করি।”

সড়কের বিপরীত পাশে ‘নিমাইয়ের মাঠা’ বিক্রি করছিলেন আরেক ব্যক্তি। বললেন, তিনিই নিমাই। তার কাছে জানতে চাইলে বললেন, “মাঠা তৈরি শিখেছি আশরাফ ওস্তাদের কাছে। আমার মাঠা আমিই বিক্রি করি, কাউরে দিই না।”

প্রথম রোজায় রোববার চকবাজার থেকে ইফতার কিনছেন ক্রেতারা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

প্রথম রোজায় রোববার চকবাজার থেকে ইফতার কিনছেন ক্রেতারা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

নিমাই উল্টো বলেন, “ওই যুবক কীভাবে মাঠা তৈরি করছে একটু জিজ্ঞাসা করেনতো দেখি।”

কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সেই যুবক কোনো কথা বলতে রাজি হলেন না।

শাহী মসজিদের সামনের সড়কে ইফতারির পসরা নিয়ে যারা বসে ছিলেন, তাদের একজন আমির হোসেন। তার কাছে ছিল তিন ধরনের পরোটা। কার পরোটা জানতে চাইলে বললেন, সোয়ারীঘাট থেকে এনেছেন।

কথায় কথায় জানা গেল, বনফুলের দোকানের পাশে একটি জায়গায় বসে অন্য সময় চা বিক্রি করেন আমির। রোজায় চায়ের দোকান সেভাবে চলে না। তাই বিকাল বেলা বেকারির পরোটা এনে ইফতারির জন্য বিক্রি করেন।

শিক কাবাব, জালি কাবাব, টিকিয়া জালি, টিকিয়া, চপজালি, পেঁয়াজুসহ নানা ধরনের ভাজাপোড়া খাবারের ডালা সাজিয়ে বসে ছিলেন আনোয়ার হোসেন।

এসব খাবারের ইতিহাস জানেন? এই প্রশ্নে তাকিয়ে থাকলেন আনোয়ার। জানা গেল, অন্য সময় চুড়িহাট্টার ঢালে ভাজাপোড়া বিক্রি করেন, রোজার সময় চলে আসেন চকবাজারে।

সড়কের ঠিক মাঝে ‘হারুনের দোকানে’ বিক্রি হচ্ছিল খাসির রানের রোস্ট, আস্ত মুরগি, কবুতর এবং কোয়েলের রোস্ট। আশপাশে ক্রেতাদের বেশ ভিড়।

রোজায় না হয় রাস্তার মাঝখানে, বছরের অন্য সময় হারুনের দোকানটা কোথায় বসে? দোকানের অল্পবয়সী একজন বিক্রেতা জানালেন, হারুনের ব্যবসাটা এই রোজার সময়ই হয়, অন্যসময় তিনি কিছু করেন না। 

তার কথার মাঝখানেই মাঝবয়সী এক বিক্রেতা ব্যস্ত হয়ে বললেন, “এটা বংশালের হারুন বাবুর্চির দোকান।” তার কাছ থেকে আর কোনো কথা জানা গেল না।

কাছেই ‘জব্বারের দই বড়া’ বিক্রি করছিলেন এক যুবক। দই বড়ার যে ঐতিহ্য, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই বলে জানালেন। আরেক বিক্রেতা জানালেন, অন্য সময় তিনি পান সিগারেট বিক্রি করেন, এবার রোজায় দই বড়া বিক্রি করছেন।

চকবাজারের কয়েকটি ইফতারের দোকানে দেখা গেল ড্রাম থেকে পেস্তা বাদামের শরবত বোতলে ভরছেন বিক্রেতারা। তারপর বোতলের ওপর বিভিন্ন কোম্পানির নাম দেওয়া লেবেল সেঁটে দিচ্ছেন।

ফালুদা ও লাবাং বিক্রি করছিলেন জুয়েল নামে এক ব্যক্তি। বছরের বাকি সময় জুয়েলের পরিচয় ইলেকট্রিত মিস্ত্রি! ফালুদা ও লাবাং কোথায় তৈরি করেছেন, আর কার কাছ থেকে শিখেছেন জানতে চাইলে কোনো জবাব মেলেনি।

আফসোস!

শালিমার রুটি, চাপাতি রুটি, নান রুটি, নানখাতাই, শিক কাবাব, হাঁড়ি কাবাব, মাংসের কোফতা, শামী কাবাব, টিকা কাবাব, শাহী পরোটা, শবরাতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদা ও শরবত চকবাজারের ইফতারির বিখ্যাত সব পদ।

“এসব এখনও পাওয়া যায়, কিন্তু যারা তৈরি করছেন এরা সব মৌসুমি ব্যবসায়ী,” আক্ষেপের সুরে বলেন, আলাউদ্দিন সুইটমিটের মালিক মো. মারুফ।

পুরান ঢাকার এই বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পূর্ব পুরুষরা ভারতের লখনৌয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছিল ১৮০০ সালে, আর বাংলাদেশে ১৮৫০ সালে।”

নিজেকে এই ব্যবসার চতুর্থ প্রজন্ম দাবি করে তিনি বলেন, “চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো ঘি দিয়ে তৈরি করা হত। কিন্তু ভুঁইফোড় দোকানিদের দৌরাত্ম্যে আমরা দিশেহারা।”

ফারুক জানান, ‘ঐতিহ্য রেখে’ সেসব খাবার তৈরি করতে এখন অনেক খরচ। তাই শরবত, ফালুদাসহ কয়েকটি পদ তারা তৈরি করেন।

জিলাপি, পরোটা, দই, রসমালাইসহ নিজস্ব কয়েকটি খাবার ছাড়া ইফতারে আর কিছু রাখেনি বোম্বে কনফেকশনারি।

আনন্দ কনফেকশনারিতে কয়েক ধরনের রুটি ছাড়াও মুরগির রোস্ট পাওয়া যায়। তবে এসব খাবার চকবাজারের ঐতিহ্যকে বহন করে না।

ইফতারির রাজ্যে ভয়

ঐতিহ্যের স্বাদ নিতে প্রতিদিনই চকবাজারে ছুটে আসেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ। হাঁকডাকে মুগ্ধ হয়ে কিনে নেন বাহারি নামের সব ইফতার। তবে স্থানীয়রা বললেন, রাস্তার অস্থায়ী দোকান থেকে তারা ইফতার কেনেন না।

বাশার নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বললেন, “আরে না, কখনও এদের ইফতারি খাই না। এদের খাবার খেলে দুই দিনেই অসুস্থ হয়ে পড়ব।”

‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামে এক খাবার ঘিরে প্রতি বছর পত্রিকায় আলোচনা হয়। সে প্রসঙ্গ টেনে বাশার বলেন, “এইটা কী? মানুষ কেন হুমড়ি খাইয়া এইটা কিনে?”

পুরো চকবাজারের ইফতারের বাজারে দুই ধরনের ক্রেতা পাওয়া গেল। কিছু মানুষ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন, আর অন্যরা স্থানীয়। তাদের কেনার ধরনও আলাদা।

স্থানীয়রা নির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকে মাঠা, ফালুদা বা দইবড়া কেনেন। তাদেরকে তিন থেকে চার ধরনের বেশি ইফতার কিনতে দেখা যায়নি।

আর যারা চকবাজারের নাম শুনে এসেছেন, তারা মাঝ সড়কের দোকান থেকে কেনেন। তারা ৯ থেকে ১০ ধরনের ইফতার কেনেন। আস্ত কবুতরের রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারই থাকে তাদের তালিকায়।

চকবাজারের ইফতার কিনতে খিলগাঁও থেকে এসেছেন অনিক নামে এক যুবক। সড়কের মাঝখানের এক দোকান থেকে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ কিনলেন আধা কেজি ৩০০ টাকা দিয়ে। একটি খাসির রান কিনলেন ১০০০ টাকা দিয়ে। আর পাঁচটি কোয়েলের রোস্ট কিনলেন প্রতিটি ৭০ টাকা করে। তারপর পেস্তার শরবত, ফালুদা, ভাজাপোড়া সব পদই কিনলেন।

এত খাবার কেন? অনিক বললেন, “কতদূর থেকে এসেছি। সব সময় চকবাজারের ইফতারির নাম শুনেছি। তাই এবার এলাম, একটু বেশি করেই নিলাম। বাসায় বাবা-মা আছে, বন্ধুদেরও দাওয়াত দিয়েছি।”

পেট মানবে তো?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসব খাবারের মধ্যে কোনটির পুষ্টিগুণ কতটা তা তাৎক্ষণিকভাবে বলা যাবে না।

“তবে এগুলো যে স্বাস্থ্যকর না, তা বলা যায়। ভাজাপোড়া খাবার এমনিতেই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। যদি ওই খাবার তৈরি করা হয় পুরনো তেলে, তাহলেতো কথাই নেই।”

এই গরমে রসালো ফলের দিকে সবাইকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রত্যেকের ইফতারের তালিকায় সুষম খাবার রাখার পরামর্শ দেন এই পুষ্টিবিদ।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খোলা জায়গায় বিক্রি করা এসব খাবার খেলে ডায়রিয়া, আমাশয় আর জন্ডিসের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

“এসব খাবার তৈরিতে খাদ্যগুণ বজায় রাখা হয় না। ফলে ওইসব রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও পেটে ব্যাথা, পেট ফুলে যাওয়া, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ও বদহজম  ভোগাতে পারে।”

ভাজাপোড়া খাবার গরমের এই সময়টায় শরীরে আরও বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলে জানিয়ে অল্প পরিমাণে এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এই চিকিৎসক।