এভাবে গত ১২ বছরে তারা ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন সোনার
দোকানে চুরির সঙ্গে জড়িত ছিল।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায়
রাঙাপরী জুয়েলার্স থেকে প্রায় ৩০০ ভরি সোনা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে
সোমবার রাতে মুন্সীগঞ্জ ও বরিশাল থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তারা হলেন- মো. কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টার (৪২),
মো. রাজা মিয়া (৫৪) ও মো. মাসুদ খান (৪২)। তাদের কাছ থেকে লুট করা ১৯ দশমিক ৭০ গ্রাম
সোনা ও নগদ ৩ লাখ ২৯ হাজার ১৮০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার
খন্দকার আল মঈন জানান, এই চক্রের হোতা রাজা মিয়া আর বাকি দুজন তার সহযোগী। তারা ইতোপূর্বে
বিভিন্ন মামলায় র্যাবের হাতে একাধিকবার গ্রেপ্তারের পর বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগও করেছে।
“তাদের অপরাধের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, তারা প্রথমে
ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদপত্র ইত্যাদি ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাদের
লক্ষ্যবস্তু দোকান সমূহে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগদান
করে বা দোকান ভাড়া নেয়।
“পরবর্তীতে স্বর্ণালংকার লুট করার পর তারা আত্মগোপনে
চলে যায় ও নিজেদের মধ্যে সর্বপ্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কিছুদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক
হলে নতুন লক্ষ্যবস্তু ঠিক করার জন্য ফের তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করে।”
একই পদ্ধতিতে চক্রটি ২০১৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের জয়পুরহাট
শাখার ভল্ট ভেঙে এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা লুট করে বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা মঈন।
“এই ঘটনায় তারা ব্যাংকের পাশের একটি ঘর এনজিওর নামে মিথ্যা
পরিচয়ে ভাড়া নেয়। ভল্ট লুটের এক সপ্তাহ আগে থেকে স্কু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেয়াল কেটে
ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে ওই টাকা লুট করে পালিয়ে যায়।”

পরে র্যাবের অভিযানে রাজা মিয়াসহ ৭ জন গ্রেপ্তার করা
হয়েছিল। ওই ঘটনায় রাজা মিয়া ৩ বছর কারাগারে ছিলেন।
একইভাবে চক্রটি ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে দুটি সোনার দোকানে
ডাকাতি করে ৪৫৫ ভরি সোনা ও ২ লাখ টাকা লুট করে বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার
পরিচালক।
তিনি বলেন, “চক্রটি ২০২০ সালে ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজায়
স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ২৩০ ভরি স্বর্ণ ও এক লাখ ৫০ হাজার টাকা লুট করেছিল।
“ওই ঘটনার দুই মাস আগে এই চক্রের তিন সদস্য মিথ্যা পরিচয়ে
একটি সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ড হিসেবে মার্কেটের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিল।”
র্যাব মুখপাত্র আল মঈন জানান, তারা সংঘবদ্ধ
ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের সক্রিয় সদস্য। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮
থেকে ১০ জন।
“তারা সকলেই বিভিন্ন পেশার আড়ালে দীর্ঘদিন যাবৎ পারস্পরিক
যোগসাজশে দেশের বিভিন্ন স্থানের স্বর্ণের দোকান লুট, ব্যাংক ডাকাতি ও বিভিন্ন মার্কেটে
লুট করে আসছে।”
কচুক্ষেতের রাঙাপরী জুয়েলার্সের চুরির ঘটনা বর্ণনা দিতে
গিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী কাউসার ঘটনার দেড় মাস আগে
রজনীগন্ধা মার্কেটে ভুয়া পরিচয়ে একটি দোকান ভাড়া নিয়েছিল। তিনি ওই দোকানে নাম সর্বস্ব
মালামাল রেখে কৌশলে চুরির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মজুদ করেন।
“পরিকল্পনা অনুয়ায়ী, রাজা মিয়া ও তার সহযোগী কাউসার মাস্টারসহ
আরও তিন থেকে পাঁচজন ওই রাতে মিরপুর ১৪ নম্বরের গোল চত্বরে একত্রিত হয়। আর মাসুদ যিনি
তখন ওই মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিল, সে মার্কেটের অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীদের
কৌশলে খাবার ও পানীয়ের সাথে চেতনানাশক সেবন করিয়ে তাদের অজ্ঞান করে।”
র্যাব জানায়, পরিকল্পনা মোতাবেক অন্যরা মার্কেটের সামনে
আসলে মাসুদ ও তার এক সহযোগী গেটের তালা খুলে তাদেরকে কাউসারের ভাড়াকৃত দোকানের ভিতর
নিয়ে যায়।
কাউসার মাস্টার ও তার এক সহযোগী মার্কেটের বাইরের চারপাশ
নজরদারিতে থাকে। রাত ২টার দিকে কাউসারের দোকানে মজুত করে রাখা তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি
দিয়ে দুটি দোকানের তালা এবং শাটার ভেঙে রাজা মিয়াসহ আরও দুই থেকে তিনজন দোকানের ভিতর
প্রবেশ করে। এরপর তারা দোকানের ভিতর থাকা স্বর্ণলংকার ও নগদ টাকা লুট করে কাউসারের
ভাড়াকৃত দোকানে নিয়ে যায়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক জানান, ঘটনার
সময় মাসুদ দোকানের বাইরে পাহারা দেন। দোকানে যে স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়েছে, তা যেন বোঝা
না যায়, সেজন্য তারা দোকানে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়।
“ভোরে মালামালসহ কেরানীগঞ্জে কাউসার মাস্টারের পূর্ব
থেকে ভাড়াকৃত বাসায় চলে যায় এবং ঘটনার দিন সকালেই তারা লুটকৃত স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ
টাকা, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যায়।
“রাজা মিয়া একজন দক্ষ তালা ভাঙার মেকার এবং অন্যান্যরা
বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী। তারা খুব সাধারণ বেশভুষা ধারন করে চলাফেরা করত, যেন কেউ তাদেরকে
কোনো প্রকার সন্দেহ না করে।”
মাসুদ কী করে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি পেল, এ প্রশ্নের উত্তরে র্যাব কর্মকর্তা মঈন
বলেন, “কাউসার মাস্টার সকল প্রকার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি
করে রাজধানীর মিরপুরের একটি সিকিউরিটি এজেন্সির নাম ব্যবহার করে মাসুদকে রজনীগন্ধা
মার্কেটে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়।
“চাকুরিতে যোগদানের পর থেকেই সে মার্কেটের সিকিউরিটিসহ
অন্যান্য বিষয়ের খোঁজ-খবর নিতে থাকে এবং স্বর্ণের দোকান লুটের পরিকল্পনা করতে থাকে।”
চক্রের হোতা রাজা মিয়ার উত্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে মঈন
জানান, ১৯৯০ সালে বাসের কনডাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০০২ সালের দিকে এই সংঘবদ্ধ
চক্রের সঙ্গে তারা সখ্য গড়ে ওঠে; সেই থেকে রাজা মিয়া অপরাধে জগতে প্রবেশ করে। ইতোপূর্বে
রাজা মিয়া চুরি ও ডাকাতির দুটি মামলায় কারাভোগ করেন।
মাসুদ ঢাকার চাইনিজ রেস্তোরাঁয় ক্লিনার ও বয় হিসেবে
কর্মজীবন শুরু করে। রেস্তোঁরায় চাকরি করা অবস্থায় ২০১০ সালের দিকে এই চক্রের সঙ্গে
তার পরিচয় ও সখ্যতা গড়ে ওঠে।
২০১৬ সালে নারায়নগঞ্জে একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেয় মাসুদ।
২০১৮ সাল পর্যন্ত নারায়নগঞ্জে থাকা অবস্থায় সিদ্ধিরগঞ্জে হাজী আহসান উল্লাহ সুপার মার্কেটের
দুইটি টি স্বর্ণের দোকানের প্রায় ২ কেজি স্বর্ণ লুট করে। সেই লুটের ঘটনায় মাসুদ কারাবরণ
করে।
তার নামে তিনটি চুরির মামলা রয়েছে বলে জানান র্যাবের
পরিচালক মঈন।
কাউসারেরও অপরাধ জগতে প্রবেশের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন,
“মাধ্যমিক পাস কাউসার হোসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্পে চাকরি নেয়। পরবর্তীকালে
২০০৯ সাল হতে ঢাকায় এক আইনজীবীর অফিস সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০১৮ সালে মামলা
সংক্রান্ত বিষয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের এক সদস্য আদালতে আসলে সেখানে
কাউসারের সঙ্গে পরিচয় হয়।
“ওই সদস্যের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়
কাউসারের এবং ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের স্বর্ণালঙ্কার লুটে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাউসার
অপরাধ জগতে প্রবেশ করে।”
মঈন বলেন, “অপরাধ জগতে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের
জন্য এবং ভুয়া সব কিছু তৈরি করতে সিদ্ধ বিধায় কাউসারকে তাদের চক্রের সকল সদস্য মিলে
মাস্টার উপাধি দেয়।
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার এই তিনজনসহ কচুক্ষেতে সোনা চুরির ঘটনায় চারজন গ্রেপ্তার হলো।
ঘটনার কয়েকদিন পরই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ শামীম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল।
শামীম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন।