ক্যাটাগরি

সব দলকে ভোটে আনতে ‘সর্বোচ্চ চেষ্টার’ পরামর্শ

নির্বাচন কমিশন আয়োজিত ধারাবাহিক সংলাপের তৃতীয় ধাপে বুধবার সকালে নির্বাচন ভবনে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক, কলাম লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।

সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করতে ‘সর্বশক্তি’ দিয়ে চেষ্টা করবেন এবং তাতে কোনো ‘ত্রুটি থাকবে না’।

সংলাপে দ্য ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবর্তে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করাটাই ইসির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

“আপনাদের সিদ্ধান্ত হল- নির্বাচনের দায়িত্ব আপনার, সেটা সুষ্ঠুভাবে করেন, সেখানে সব দল অংশগ্রহণ করার মতো সাহস, উৎসাহ, আস্থা পাবে, সেটাই আপনারা তৈরি করবেন।”

জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো কতটুকু সুষ্ঠুভাবে করতে পারবেন, তার উপর ইসির সার্থকতা আসবে বলেও মনে করেন তিনি।

“কোনো দল নির্বাচন বয়কট করেছে-এর চেয়েও বড় সিদ্ধান্ত হল বয়কটের মধ্য দিয়েও সুষ্ঠু নির্বাচন যদি আপনারা দেখাতে পারেন, সেটাই আপনাদের সার্থকতা। কোন দল আসবে, কোন দল বয়কট করবে সেটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।”

গত ১৩ মার্চ প্রথম দফায় ৩০ শিক্ষাবিদকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানায় নির্বাচন কমিশন। ওই বৈঠকে সাড়া দিয়ে ১৫ জন উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় দফায় ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিককে আমন্ত্রণ জানালে সংলাপে অংশ নেন ১৯ জন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মতামত জানতে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত এই সংলাপে বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে ইসির বৈঠকে ২২ জন অংশ নিয়েছেন।

কাজী হাবিবুল আউয়ালকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অপর চার সদস্যকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হয়।

নতুন ইসিকে উদ্দেশ্য করে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “ইসি নিজেদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করবেন কী করতে চান। সবই আছে ইসির। ক্ষমতা আছে, দায়িত্ব আছে, জনগণ পাশে আছে, মিডিয়া রয়েছে। তাহলে ভয় কিসের?

“সংলাপের মধ্য দিয়ে যত না আস্থা সৃষ্টি করতে পারবেন, তার চেয়ে বেশি পারবেন কাজ দিয়ে।”

তবে রাজনৈতিক সমঝোতার দায়িত্ব ইসির নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ইসি এমন নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যেখানে সব রাজনৈতিক দল ভোটে অংশ না নিলে পিছিয়ে পড়বে এমন ধারণা সৃষ্টি হলে সব দল আসবে।

“যারা ভোট বয়কট করছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তারা না গেলে রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হবে। তাহলে কমিশনকে বলতে হবে না- আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে দল ভোটে আসবে।”

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে সুনামের অধিকারী হলেও কিন্তু একটি জায়গায় হোঁচট খেতে হয়। সেটি হল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা। আজ ইসির হাতে সে দায়িত্বটি পড়েছে।”

ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, এ কলঙ্ক থেকে আপনারা আমাদের যদি মুক্তি দিতে পারেন তাহলে দেশের মানুষ কৃতজ্ঞ থাকবে। দায়িত্ব যখন নিয়েছেন, কি দায়িত্ব কি সমস্যা কি দুর্বলতা আপনারা জানেন।

সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপে ইসি
 

রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে ইসির কাজ দুরূহ হবে: সিইসি
 

“আমাদের পরামর্শ নয়, আপনাদের উইল ফোর্স আপনাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে।…যারা জয়ী তারা কখনো কুইট করেন না। আপনার কাওয়ার্ডস হবেন না, আপনার ভিক্টোরিয়াস হবেন।”

প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, “নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। …সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে নির্বাচনে থাকতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার কমিশনকে করতে হবে।

“কমিশন এ বিষয়ে (সব দলের অংশগ্রহণ) কতটা সক্ষমতা দেখাতে পারবে জানি না। তবে চেষ্টা করতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হবে না। কারণ, যে নির্বাচন হবে সেটা সুষ্ঠু হবে না। যেহেতু পক্ষপাতমূলক হবে, একতরফা হবে।”

ইসির প্রতি একতরফা নির্বাচন না করার আহ্বান জানিয়ে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক বলেন, “যারা ক্ষমতায় থাকেন তারাই নির্বাচনে অংশীদার হয়। অংশীদার ও নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এটি কিভাবে নিরসন করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে।

“নির্বাচনে যারা অংশীদার তারা ক্ষতায় থাকলে কী কী অসুবিধা, প্রভাব বিস্তার করতে পারে, হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যাবে তাদের, সে ব্যাপারেও ইসির চিন্তাভাবনা করা উচিত।”

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও ঐক্যমত্য না হওয়াকে রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেন সোহরাব হাসান।

“স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজও নির্বাচন নিয়ে একটি ঐক্যমত্যে আসতে পারিনি আমরা। এটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা। এখন যারা ক্ষমতায়, অতীতে যারা ছিল তাদেরও আত্ম উপলব্ধি করতে হবে কেন তারা পারছেন না এটি।”

সব দলকে এক মঞ্চে প্রচার চালানোর ব্যবস্থা করলে সংঘাত-সংঘর্ষ অনেকটা কমে যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।

সোহরাব হাসান বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনে সারাদেশে ইসির চাওয়া যদি পূরণ না হয় সেক্ষেত্রে ইসিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে-নির্বাচন করবেন কি, করবেন না।”

ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ এর সম্পাদক নূরুল কবীর জানান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে পাকিস্তানিরা মানেনি বলে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ছিল না।

নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিন কাজের মাধ্যমে: আহ্বান ইসিকে
 

সবার কথা শুনে রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকবে ইসি
 

নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু একটি ভোট আয়োজনের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমান ইসির হারাবার কিছু নেই। মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।”

নূরুল কবীর বলেন, “তখন যে রকম একটা ইলেকশন হয়েছিল সেই রকম ইলেকশন যদি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এ সময়ে করতে না পারি সেটা ইসির, আমাদের, রাজনৈতিক দলগুলো- সবার জন্য লজ্জাজনক।”

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাইদ খান ইসিকে ভালো নির্বাচন করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “নির্বাচনের সময়ে সরকার পদ্ধতি নিয়ে কথা উঠেছে, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।”

তিনিবলেন, “সরকারের রূপরেখা কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ইসি যেহেতু সাংবিধানিক পদে রয়েছে সেক্ষেত্রে তারা আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে।”

ইভিএমের ত্রুটি রয়েছে উল্লেখ করে এ সাংবাদিক জানান, গত সিটি নির্বাচনে তিনি ভোট দিতে পারেননি। ইভিএম পদ্ধতি বাতিলের পক্ষেও মত দেন তিনি।

যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, “নির্বাচনে সব দলকে আনতে অনবরত চেষ্টা করতে হবে কমিশনকে। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

“নির্বাচন কমিশনকে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সুষ্ঠু ভোটের জন্য ইসির পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও সরকারের সদিচ্ছা দরকার রয়েছে।”

একদিনে ভোট না করে বিভাগগুলোতে আলাদা ভোট আয়োজনের পরামর্শ দেন ইত্তেফাক সম্পাদক তাসনিমা হোসেন।

সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ইসিকে আস্থা অর্জনের তাগিদ দেন বাংলাদেশ জার্নাল সম্পাদক শাহজাহান সরদার।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহবুব কামাল মনে করেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট না করে ব্যালটে করার ঘোষণা দিলেই বর্তমান ইসি ৫০ শতাংশ আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

সেইসঙ্গে সমঝোতা ছাড়াই কীভাবে ভালো নির্বাচন করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগী হতে পরামর্শ দেন তিনি।

জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “ইসি চাইলেই ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। সব দলের অংশগ্রহণে ভোট করতে হবে। যারা বয়কট করছে তাদের যেভাবেই হোক নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সব দল ভোটে অংশ নিলেই গ্রহণযোগ্য হবে নির্বাচন।”

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক বিভু রঞ্জন সরকার জানান, কমিশন জানে কীভাবে ভালো নির্বাচন করতে হবে। এখন সবাই যাতে ভোটে অংশগ্রহণ করে তা নিশ্চিত করতে হবে।

‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চেষ্টায় ত্রুটি থাকবে না’

সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপে সবার মতামত শোনার পর কথা বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেন, “আজকে আমরা সব শুনেছি, কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সবার মতামত পর্যালোচনা করব। …সাংবিধানিকভাবে আইন ও বিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছি।

“সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রয়াসে কোনো ত্রুটি থাকবে না। সর্বপ্রয়াস, সর্বশক্তি দিয়ে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন করার চেষ্টা করব।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল বলেন, “সবার পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণা থেকে উইল ফোর্স সৃষ্টি হয়। উইল ফোর্স নিজে নিজে সৃষ্টি করতে পারব না।”

তিনি বলেন, “আজকের বক্তব্য থেকে জাতি শুনেছে। সব পরামর্শ প্রণিধানযোগ্য। চ্যালেঞ্জ যেসবের কথা বলেছে, আস্থার সংকট, পেশি শক্তি- এসব সমস্যাগুলো মূল্যায়ন করে, সব পরামর্শ পর্যালোচনা করে বাস্তবমুখী কাজ করব।”

গনমাধ্যমের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “মিডিয়াকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। মিডিয়ায় সবকিছু প্রতিফলিত হয়। সবার পরামর্শগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নেওয়া হবে। সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করা হবে।

এ সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান, রাশেদা সুলতানা এমিলি, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকদের মধ্যে আলোচনায় আরো অংশ নেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, মানবকণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দুলাল আহমেদ চৌধুরী, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক, ডেইলি অবজারভারের অনলাইন ইনচার্জ কাজী আব্দুল হান্নান, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, আজকের পত্রিকা সম্পাদক মো. গোলাম রহমান, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ইনাম আহমেদ, ভোরের ডাক সম্পাদক কে এম বেলায়েত হোসেন, প্রতিদিনের সংবাদ এর সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম, দৈনিক আমার সংবাদ এর সম্পাদক হাশেম রেজা।