রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রানীনগর গড়বাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের মোট ৬৫টি বাড়ির একটি বাড়ি তার। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে গতবছর আধাপাকা বাড়িটি পেয়েছেন তিনি।
হানুফা এখন নিজে কাপড় আর কাঁথা সেলাই করে অর্থ উপার্জন করছেন। স্বামী অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করছেন। তাদের একমাত্র ছেলেটি পড়ছে দশম শ্রেণিতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে পরের বাড়িতে থাকতাম। আজ এইখানে, কাল ওইখানে। এখন আমার মাথার উপর নিজের চালা হয়েছে। স্বামী স্ত্রী কর্ম করছি, দিন শেষে আমাদের নিজের একখান বাড়ি আছে- এইটাই শান্তি।”
এক বছর আগেও হানুফারা থাকতেন অন্যের বাড়িতে। বহুকাল আগে আলীপুরে পদ্মা নদীর ভাঙনে বাড়িঘর সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তখন থেকেই পরের বাড়িতে কাটছিল জীবন।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
বিয়ের পর এই অনিশ্চিত জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন হানুফা। থাকা খাওয়া নিয়েই যেখানে অনিশ্চয়তা, সেখানে ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ভাবনা তার কাছে ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা।
সেসব দিন এখন অতীত। এখন আরও সামনে তাকানোর সাহস পাচ্ছেন হানুফা। তিনি বললেন, “ব্যাটাটাকে পড়াচ্ছি। ওকে মানুষ করব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এই বাড়ি দিয়েছেন, আমাদের স্বপ্ন বেড়ে গেছে। তার জন্য আমার দোয়া থাকল।”
হানুফার মত কিছুদিন আগেও যাদের মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না, আশ্রিতের পরিচয়ে দিন কেটেছে, তাদের অনেকেই এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের রঙিন টিনে ছাওয়া আধাপাকা ঘর পেয়েছেন।
সেসব বাড়ির সামনে এক ফালি আঙিনায় শাক-সবজি চাষ করছেন অনেকে, কেউ কেউ হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলও পালন করছেন।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে ভাবনা না থাকায় নিজেরা কাজ করে সংসার চালিয়ে, সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছেন জীবন, তাদের সংসারে আসেছে স্বনির্ভরতার ছাপ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষে সারাদেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করে তাদের জমিসহ ঘর উপহার দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রতিটি পরিবারকে দুই শতক জমির মালিকানাসহ আধাপাকা ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে রান্নাঘর ও টয়লেটও আছে।
হানুফার মত নদীভাঙনে সব হারানো গোদাবাড়ীর এবাদুল হক এক সময়ে দিনমজুরের কাজ করতেন। রানীনগর গড়বাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়ার পর এখন তিনি খড়ের ব্যবসা করেন। তার জীবনেও স্বস্তি ফিরেছে এখন।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
“জীবন কাটছে ভেসে ভেসে। এই এলাকাতেই থাকতাম পরের বাড়িতে। শেখ হাসিনা আমাদের ঘর দিছেন। সারাদিন খেটেখুটে এসে রাতটা থাকতে পারি শান্তিতে।”
সাতজনের সংসার একাই টেনে নিয়ে চলা এবাদুল চার ছেলেকে স্কুলেও পাঠাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখছেন, লেখাপড়া শিখে স্ন্তানরা বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে।
“ছেলেরা যদি লেখাপড়া করতে চায়, তাহলে আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাব তাদের মানুষ করতে। যত কষ্টই হোক।”
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ২ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপরে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬০টি বাড়ি তৈরি করে হস্তান্তর করা হয় গতবছর। এ অঞ্চলের গৃহহীন ৬০টি পরিবার সেসব বাড়ি পেয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জানে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তৃতীয় ধাপে আরও পাঁচটি বাড়ির কাজ চলছে। এগুলো শিগগিরই হস্তান্তর করা হবে।”

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
গত এক বছরে এখানকার মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তাদের প্রায় সবাই নদীভাঙনের শিকার ছিল। বহুবছর মানুষগুলো থাকা খাওয়া নিয়ে কষ্ট পেয়েছে। তারা এখন তাদের জীবন মান উন্নত করার চেষ্টা করছে।”
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রভাবশালীদের দখল থেকে মুক্ত ১০ একর জমির মধ্যে ৭ একর জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘খোকশাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প’। শহরের বুকে তৈরি হয়েছে এক টুকরো আদর্শ গ্রাম।
এখানে প্রথম পর্যায়ে ১০০টি ঘর, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১২০টি এবং তৃতীয় পর্যায়ে ৪৪টি ঘরের মধ্যে ২১টি নির্মাণ করা হয়েছে। ২৩টি ঘর নির্মাণাধীন। মুক্তিযোদ্ধা, রিকশাচালক, দিনমজুর, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা এবং প্রতিবন্ধীসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের দুস্থ মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছেন এই প্রকল্পে।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
খোকশাবাড়ীতে নিজের ঘর পেয়েছেন ৩৫ বছর বয়সী নার্গিস খাতুন। খুব ছোটবেলায় টাইফয়েডে বাঁ পায়ের চলৎশক্তি হারানোয় তাকে চলাফেরা করতে হয় ক্র্যাচে ভর দিয়ে। স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন, এখন সেখানেই তার মনোযোগ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে মনে করেন যে চায়াচিন্তা খাইছি। জায়গায় জায়গায় থাকছি। কখনও স্বামীর বাড়ি, কখনও বাপের বাড়ি। ছোটবেলা থেইক্কাই পায়ে সমস্যা। কোনোখানে বিয়া দিতে পারবোনা ভাইবা বাবা এই লোকের কাছেই বিয়া দিছিল। আমার স্বামী থাইকাও নাই।”
সেই নার্গিস এখন তার পাঁচ বছরের ছেলে ইয়াসীনকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন, স্কুলে পাঠাবেন সামনে। বাড়ির আঙিনায় লাগানো শাকসবজি থেকে রান্নার কিছুটা যোগান আসে, বাদবাকিটা চলছে অন্যের সাহায্যে। তবে দিনশেষে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হয়েছে, সেটা ভেবেই আপ্লুত নার্গিস।
“এই বাড়িতো আমার। যত কষ্টেই থাকিনা ক্যান, কেউ তো আর কইবো না, বাড়ি থেইক্কা বাইর হইয়া যা,” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
খোকশাবাড়ীতেই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের বাড়ির সামনের খানিকটা অংশে একটা ছোট্ট দোকান করেছেন নূরে আলম এবং তার স্ত্রী আয়েশা।
যমুনার ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে বহুকাল পরের বাড়ির আশ্রয়ে থেকেছেন তারা, পাঁচবছর থেকেছেন ভাড়াবাড়িতেও। নূরে আলমের মা নূরজাহান বেগমের নামেই বরাদ্দ হয়েছে এ বাড়ি।
আশি পেরোনো নূরজাহান বেগম বাড়িটি পেয়ে আবেগে আপ্লুত; আগের জীবনের নানা কষ্টের গল্প তিনি শোনাচ্ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
“স্বাধীনতার সাত আট বছর পর বিয়া হইছিল। এরপর ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারাইছিলাম। এরপর থেইকা এমন ঢোগি ঢোগি কইরা থাকছি। জঙ্গলের মধ্যে খুম কাইট্টা বাসা বানায়াও থাকছি। ছয়ডা ছাওয়াল আছিল আমার। তিনডা আগেই মইরা গেছে। দশ বছর আগে আরেক ছাওয়াল মরল।
“অহন একটা মাইয়া আর এই ছাওয়াল (নূরে আলম)। বহু বছর কষ্ট কইরা আজকে আমি অহন একটা নিজের বাড়ি পাইলামগো সোনা।”
দোকান থেকে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে পাঁচজনের সংসার কোনোরকমে চলে জানিয়ে নূরে আলম বলেন “বাড়িটাই অহন আমাগো শক্তি।”
এ প্রকল্পে নিজের বাড়ির সামনে টার্কি মুরগির ছোট্ট একটা খামার করেছেন খাদিজা আক্তার। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের বাড়িটিকে নিজের মত করে সাজিয়েও নিয়েছেন। নিজ উদ্যোগে বাড়িয়েছেন একটি ঘর। তবে পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে খামারের উদ্যোগটি এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
খাদিজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেখ হাসিনা আমারে এই ঘরটা দিলেন। তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা। আমি চেষ্টা করতেছি সাতজনের সংসারটারে ঠিকভাবে চালাইতে।
“আমার একটা মুরগির ফার্ম দেওয়ার শখ ছিল। আশা কইরাই তুলছিলাম। কিন্তু টাকার অভাবে বাড়াইতে পারতেছিনা। কিস্তিও যদি তুলি, ৪০ হাজার টাকার কিস্তি তুইলা আমার ফার্মটা চালাইতে পারব। দেখি আল্লায় যদি এখন মুখের দিকে তাকায়।”
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হয় গৃহহীন ভূমিহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজ। ইতোমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি বাড়ি দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন প্রকল্প পরিচালক আবু ছালেহ মো. ফেরদৌস খান।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা হচ্ছে, দেশে কোনো গৃহহীন থাকবে না। সে নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ধাপে ধাপে কাজ করছি।”
আরও ৬৫ হাজার ৪৭৪টি বাড়ির নির্মাণের কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এবার বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে এগুলো করছি। যাতে বাড়িগুলো মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।”