১৮ নাগরিকের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে ধর্ম অবমাননার ‘মিথ্যা অভিযোগে’ গ্রেপ্তার ও জামিন না দেওয়া, ঢাকায় কলেজ শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার কারণে পুলিশ সদস্যের হেনস্তা, মুজিব শতবর্ষে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙা সমর্থন করে এবং ভাস্কর্য ‘ইসলাম বিরোধী’ কাজ বলে পুলিশ সদস্যের ফেসবুক ও সরাসরি মাইকে বক্তব্য দেওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্য ধর্মালম্বী মানুষকে ঘৃণা করার শিক্ষা সম্বলিত রচনার অন্তর্ভুক্তি, দুই বছর আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একজন সচিবের ‘টাকনু’র উপরে কাপড় পরার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি এবং বাংলা নববর্ষের প্রভাতে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ‘বিদাত’ বলে ঘোষণা করা হয়, যা নিয়েও এই বিশিষ্ট নাগরিকরা উদ্বগ্ন।
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমাদের মনে এই ছায়াপাত করে যে রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। বিগত কবছর যাবৎ সমাজে বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে, যা সামাজিকভাবে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
“কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কতিপয় সদস্য যখন সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে শিক্ষক, শিল্পী ও সাধারণ মানুষকে নানাভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত করছে, তখন জনগণের মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের মূল চারনীতি ও মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট নয়।”
সাংস্কৃতিক সংগঠক ও চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “বাঙালি সংস্কৃতিকে বিধর্মীদের সংস্কৃতি বলে মিথ্যাচার করে সরকারের ও রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থান নেওয়া স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের উত্তরসূরিরা আজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলার প্রয়াস নিয়েছে।
“রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দায়িত্বে থাকাকালে প্রতিক্রিয়াশীলদের এহেন ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে আমাদের নির্লিপ্ততা ও ধর্মান্ধদের রাষ্ট্রক্ষমতার অভ্যন্তরে শিকড় বিস্তার।”
দ্বিধা ও বিলম্ব ছেড়ে সরকারকে এই প্রবণতা রোধ করার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “এখনই সময় এ প্রবণতা রোধ এবং এর শিকড় উৎপাটন করার। আর এই দায়িত্ব মূলত সরকারের।”
বিবৃতিতে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে বলা হয়, “আমরা নিশ্চয় এ কথা সকলে স্বীকার করব যে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের অবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও সাম্প্রদায়িক পাঠদানই আজকের এই বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। কেননা আজকের দানবরূপী এই মানুষগুলো একদা শিশু-কিশোর ছিল।
“যে কিশোর ছাত্ররা মৌলবাদী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অপমান করে পুলিশে সোপর্দ করেছে, তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।”
জজ আদালতেও জামিন মেলেনি বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের
ওই ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের যারা ‘সহযোগিতা ও ইন্ধন’ যোগাচ্ছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করা হয়েছে।
বিবৃতিদাতা অন্যরা হলেন- কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন, নাট্য অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, মফিদুল হক, সাংবাদিক আবেদ খান, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান, অধ্যাপক আবদুস সেলিম, শফি আহমেদ, শাহরিয়ার কবীর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সারা যাকের, শিমুল ইউসুফ, সাংবাদিক হারুণ হাবীব।
গত ২০ মার্চ মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির সাধারণ বিজ্ঞানের ক্লাস চলছিল। মানবিক ও বাণিজ্য শাখায় বিজ্ঞান পড়ানোর সময় প্রসঙ্গক্রমে এবং শিক্ষার্থীর প্রশ্নে ধর্ম নিয়ে কথা বলেন শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। ওই আলোচনা রেকর্ড করে কয়েকজন শিক্ষার্থী।
পরে ধর্ম নিয়ে ‘আপত্তিকর’ কথা বলার অভিযোগ তুলে কিছু শিক্ষার্থী এলাকায় হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। ওই অবস্থায় এ শিক্ষককে মুন্সীগঞ্জ সদর থানা পুলিশ নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়। পরে মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, ওইদিনই হৃদয় মণ্ডলকে আটক করা হয়। দুদিন পর এ ঘটনায় মামলা হলে তাকে সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ঘটনার পর হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে সাময়িক বরখাস্তও করে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতি
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি ও ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ শাস্তির দাবি জানিয়ে আলাদা বিবৃতি দিয়েছে।
সেখানে বলা হয়, “আমরা মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রের শিকার শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের নিঃর্শত মুক্তি দাবি করছি। আর যে কিশোর ছাত্ররা মৌলবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অপমান করে পুলিশে সোপর্দ করেছে, তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
“বাংলাদেশে যেভাবে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উগ্র মৌলবাদী, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রসার ঘটছে তাতে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিকৃত সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় আচ্ছন্ন পুলিশ কর্তৃক কলেজ শিক্ষক লতা সমাদ্দারের লাঞ্ছনার ক্ষত উপশমের আগেই স্কুল শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের লাঞ্ছনা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ।”
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি হৃদয় মণ্ডলকে আইনি সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।