দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে দীন মোহাম্মদ কাজ করতেন এক খাবারের দোকানে। সেখানেই ওস্তাদের কাছে হালিম রান্নার কৌশল শিখেছিলেন। পরে ছোট্ট একটি দোকান দিয়ে নিজেই হালিম বিক্রি শুরু করেন।
এখন শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরেও বহু মানুষের কাছে এক নামে পরিচিত সেই হালিম, ‘মামা হালিম’।
দীন মোহাম্মদকে এখন খুব কম লোকই তার আসল নামে চেনে। হালিম খেতে এসে খদ্দেররা ‘মামা’ বলে ডাকত, সেই থেকে তার উপাদেয় খাবারের পদটির ব্র্যান্ড হয়ে গেছে মামা হালিম। দীন মোহাম্মদ হয়ে গেছেন সবার ‘মামা’।
শুধু রোজা নয়, সারা বছরই কলাবাগানের মামা হালিমের চাহিদা রয়েছে। তবে রোজায় ইফতার আর হালিম কারো কারো কাছে যেন সমার্থক। সুস্বাদু মামা হালিমের জন্য তাই দূর থেকেও মানুষ আসে।
কিন্তু রমজানে হালিম তো পাড়ার মোড়ে মোড়েই মেলে! তাহলে এত কষ্ট করে কেন কলাবাগানে আসা? কী মজা মামার হালিমে?
সোমবার বিকালে মামার দোকানের সামনে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে নানা রকম উত্তর মিললো। কেউ বললেন, হালিমের মানটা মামা ধরে রাখতে পেরেছেন। কারও উত্তর- রহস্য আসলে রেসিপিতে। কেউ আবার করলেন তেঁতুল টকের প্রশংসা।
তবে দীন মোহাম্মদ যেটা বললেন, সেটা মোটামুটি আবহাওয়াবিদ্যা, রসায়ন আর রন্ধনশৈলীর এক জটিল তত্ত্ব।
কেন খান মামা হালিম?
আরিফা সুলতানা থাকেন খিলগাঁওয়ের গোড়ানে। রোজার মধ্যে যানজট প্রচুর। তারপরেও কলাবাগানে যাওয়ার একটা ছুতোর অপেক্ষায় ছিলেন।
“যেই একটা কাজ পড়ল, মাথায় প্রথমে এল মামা হালিমের কথা। নিয়ে যাচ্ছি। বাসার সবাই মিলে ইফতার করব।”
আরিফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামা হালিম খাচ্ছি প্রায় ১৫ বছর ধরে। এদিকে এলে মামা হালিম না খেয়ে যাই না।”
সারা দিনের রোজা শেষে পুষ্টিকর ও ক্যালরি সমৃদ্ধ এক বাটি হালিম ছাড়া অনেকেরই ইফতার জমে না। মুয়িজ মাহমুদ তেমনই একজন। কলাবাগানেই তার বাসা, ফলে যানজট ঠেলার ঝামেলা নেই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “মামা হালিম ছাড়া ইফতার ভাবতে পারি না। এদের একটা জিনিস সবচেয়ে ভালো, সেটা হলো স্বাদের তারতম্য হয়নি। সময়ের ব্যবধানে দাম বেড়েছে, কিন্তু স্বাদ ও মান মোটামুটি একই।”
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জাকিয়া রুবাবার কাছে প্রিয় মামা হালিমের তেঁতুলের টক।
“অন্য সব দোকানে হালিমের সাথে শুধু বেরেস্তা, আদা কুচি, মরিচ কুচি এসব দেয়। কিন্তু মামা হালিমের সাথে একটা পাতলা টক দেয়। ওটার জন্য অন্য হালিমের চেয়ে মামা হালিমের একটা আলাদা স্বাদ।”
কী আছে মামা হালিমে?
প্রশ্ন শুনে মামা, মানে মামা হালিমের মালিক দীন মোহাম্মদ তাকালেন আকাশের দিকে। বললেন, সেটা নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর।
“আবহাওয়া গরম হলে মসলা একরকম। বৃষ্টি হলে আকেরকম। আর শীতে আরেক রকম। আবহাওয়া অনুযায়ী শরীর কাজ করে। তাই সেই বুইঝা হালিম করতে হয়।
“ধরেন, আজকে গরম বেশি, আমি যদি ঝাল বেশি দেই, তাইলে আপনে ঠিকমত খাইতে পারবেন? পারবেন না। তাইলে মসলা গরমে আর শীতেতো দুই রকমেরই হবে। আবার ধরেন খুব শীত, সেদিন হালিম হবে গরম। কম শীত কম গরম হালিম। গরম মানে বুঝছেনতো? মশলার গরম।”
দীন মোহাম্মদের দাবি, একশ রকমের বেশি উপাদান লাগে তার এই হালিম রাঁধতে। তবে সবগুলোর নাম তিনি বলতে রাজি নন।
“৫-৬ রকমের ডাল, ঘি, সয়াবিন তেল, ডালডা, সর্ষের তেল, পুদিনা, ধনে পাতা, পেঁয়াজ-রসুন-আদা এসবতো থাকেই। আরও অনেক মশলা, বাদাম থাকে। সে সব তো বলা যাবে না।”
২৭ রোজায় একটি বিশেষ হালিম তৈরি করেন দীন মোহাম্মদ। তাতে থাকে একশ গরু ও একশ খাসির মগজ। আরও থাকে আলুবোখারা। আলুবোখারা কোনোটা মিষ্টি, কোনোটা টক।
আগে সবসময় দোকানে সময় দিলেও এখন দেন না। তবে হালিমটা তৈরি করেন নিজ হাতে। এ কাজে কোনো গড়িমসি হয় না মামার।
এ হালিম বিক্রি করা হয় মাটির পাত্রে। গরুর হালিমের সবচেয়ে ছোট পাত্র ২৫০ টাকা, খাসি ৩০০, আর মুরগি ২৫০ টাকা। বড় এক পাত্র গরুর হালিম ২ হাজার টাকা, খাসি ২ হজার ২০০ টাকা, মুরগিও ২০০০ টাকা।
দীন মোহাম্মদের হালিমের ব্যবসার শুরু সেই ১৯৭২ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর। কিন্তু তার রেসিপির বিশেষত্ব কী?
উত্তরে বললেন, “এই রেসেপি কেউ কাউকে শেখায়নি। আমার ওস্তাদ ছিল বিহারি। তার কাছ থেকে শিখছি, আর নিজের হাতের কাজ। আমার দুই ছেলে আছে। তারা কিছু কিছু জানে, কিন্তু সবটা জানে না। যে শিখতে চাইব, মরার আগের তারেই শিখামু।”
হালিম এল কোথা থেকে?
হালিম নামের উৎপত্তি আরবি ‘হারিস’ থেকে। এর অর্থ হচ্ছে পিষে ফেলা।
তুরস্ক, ইরান, মধ্য এশিয়া, আরব, আর্মেনিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় এই খাবারের তুতো ভাইবোনদের দেখা মেলে। যার মূল উপাদান, মাংস, ডাল, গম বা বার্লি আর মসলা। এই মসলা অঞ্চল ভেদে হালিমের স্বাদে এনেছে ভিন্নতা।
বাংলাদেশে যেমন ডাল, চাল, গম ও অন্য উপকরণের ঘন ঝোলের মধ্যে মাংসের টুকরো পাওয়া যায়, তেমনি আবার অনেক জায়গার হালিমে আস্ত মাংসের টুকরা খুঁজেই পাওয়া যাবে না। সেখানে মাংস পিষে বাকি উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে ঘন তরল একটা খাবার তৈরি করা হয়, যেটা স্যুপের কাছাকাছি কিছু।
প্রথম লিখিত আকারে হালিম, বলা ভালো হারিসের যে রন্ধনপ্রণালীর সন্ধান পাওয়া যায়, সেটা দশম শতাব্দীর। আরব লিপিকার আবু মোহাম্মদ আল-মুজাফফর ইবনে সায়রারের ‘কিতাব আল-তাবিখ’-এ হারিসের কথা জানা যায়।
আরব সাম্রাজ্যের বিস্তারের হাত ধরেই এই খাদ্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, আর যেতে যেতে রূপ বদলায়।
খাদ্য সংস্কৃতির সুলুক সন্ধান যারা করেন, তাদের অনেকের মতে, হায়দ্রাবাদের নিজামের সৈন্য দলের আরবীয় সৈনিকদের মাধ্যমে খাবারটি ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয়তা পায়। অনেকে আবার মনে করেন, মুঘলদের হেঁশেলেও এই পদ রান্না হত। তাদের মাধ্যমেই এটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
২০১০ সালে ভারতীয় জিআইএস রেজিস্ট্রি অফিস হায়দ্রাবদি হালিমকে ‘ভৌগলিক নির্দেশক খাদ্য’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। ভারতে হালিমই প্রথম আমিষ খাবার, যা এ ধরনের মর্যাদা পেয়েছে।
তুরস্ক, ইরান, মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত ‘কেসকেক’; আর্মেনিয়ার হারিসা, পাকিস্তানের খিচড়া আর বাংলাদেশ ও ভারতের হালিম একই পরিবারের সদস্য।
‘ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি’ বইতে সাদ উর রহমান লিখেছেন, ঢাকায় হালিমের আগমন মোগল সমসায়িক সময়েই। পুরান ঢাকায় রোজা ছাড়াও মহরম উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে হালিম তৈরির রেওয়াজ রয়েছে।
আদিতে এই হালিম রান্না হত ঢিমে আঁচে, বড় পাত্র এবং চুলায়। সময় লাগত ৭ থেকে ১২ ঘণ্টা। তবে সময়ের সাথে সাথে রান্নার কৌশলে নানা পরিবর্তন এসেছে। স্থানীয় মসলা যোগ হওয়ায় স্বাদে এসেছে বৈচিত্র্য।
মাংস পিষে অন্য উপাদানের সাথে মিশিয়ে ফেলার চল বাংলাদেশের হালিমে খুব একটা দেখা যায় না। এখানে ঘন হালিমের মাঝে পর্যাপ্ত মাংসের টুকরো না মিললে ভোজনরসিক ধরে নেন, বিক্রেতা ঠকিয়েছে!
আরেক মামার আবির্ভাব
অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও মোহাম্মদপুরে সলিমুল্লাহ রোডের মনা মামার হালিমও খাদ্যরসিকদের নজর কেড়েছে।
১৯৮৮ সালের দিকে একটি ভ্যান গাড়িতে করে হালিম বিক্রি শুরু করা মনা মিয়ার দোকানে এখন কাজ করেন কয়েকজন কর্মচারী।
তার হালিমের বিশেষত্ব হল, সেখানে কোয়েল পাখির ডিম দেওয়া হয়। সেই সাথে আচারও ব্যবহার করা হয়। ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন দামের বাটি ভর্তি হালিম বিক্রি হয়।
সেখানে হালিম কিনতে আসা আদাবরের বাসিন্দা মারুফ খান বললেন, “বাসার ছোটরা কোয়েল পাখির ডিম পছন্দ করে, সেজন্য এখানে আসা। হালিমটা খেতেও সুস্বাদু। আর মনার হালিম আমরা অনেক দিন ধরে খাই। স্বাদের তারতম্য খুব একটা হয় না।”