পুতিনের এই দুই মেয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় নন। এমনকী তাদের ভালো করে চেনেও না বিশ্বের মানুষ। তাহলে কেন তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার নিশানা হলেন? এর কারণ ব্যাখ্যায় মার্কিন এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেছেন, মারিয়া ও কাতেরিনার কাছে পুতিনের অনেক সম্পদ লুকানো আছে, এমনটাই বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, কাতেরিনা একজন প্রযুক্তি নির্বাহী। তার কাজ রাশিয়ার সরকার এবং দেশটির প্রতিরক্ষা খাতকে সহায়তা করা। আর মারিয়া সরকারি তহবিলে পরিচালিত একটি প্রকল্পের প্রধান। জেনেটিক গবেষণার জন্য মারিয়ার প্রকল্প প্রতিবছর ক্রেমলিন থেকে কোটি কোটি ডলার তহবিল পান। পুতিন নিজে ওই প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন বলেও দাবি যুক্তরাষ্ট্রের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের ওই শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘পুতিন, তার বন্ধুরা এবং রুশ ধনকুবেররা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলে তাদের অনেক অর্থ এবং সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে, আমাদের এমন বিশ্বাস করার পেছনে কারণ আছে। তারা তাদের অর্থ ও সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশের অর্থ ব্যবস্থার মধ্যেই সুরক্ষিত রেখেছে।”
“আমাদের বিশ্বাস, পুতিনের অনেক সম্পদ তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখা আছে এবং এ কারণেই আমরা তাদের টার্গেট করেছি।”
ওদিকে, পুতিনের দুই মেয়ের উপর যুক্তরষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ তাদের ‘হতভম্ব’ করেছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ক্রেমলিন। তারা বলেছে, পুতিনের মেয়েদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের উন্মাদনারই অংশ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স থেকে পুতিনের মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের নাগাল পাওয়া যায়নি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সবসময়ই নিজের পরিবার নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রেখেছেন। ২০১৫ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে তার মেয়েদের পরিচয় সংক্রান্ত প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
পুতিন বলেছিলেন, “আমার মেয়েরা রাশিয়ায় থাকে এবং শুধু রাশিয়াতেই পড়ালেখা করেছে, আমি তাদের নিয়ে গর্ব করি। তারা তিনটি বিদেশি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে। আমি কখনওই আমার পরিবার নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করি না।”
রুশ নেতা সেদিন বলেছিলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ ভাগ্য গড়ার অধিকার আছে, তার মেয়েরাও ‘নিজের জীবন’ যাপন করছে এবং ‘সম্মানজনকভাবেই’ তা করছে। পুতিন এমনকি সেদিন মেয়েদের নাম পর্যন্ত বলতে চাননি।
শুধু পুতিনের মেয়েদের উপরই নয় বুধবার যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের স্ত্রীর উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
পুতিন কী পরিমাণ সম্পদের মালিক সেটা রাশিয়ায় বরাবরই একটি স্পর্শকাতর বিষয়। দেশটির বিরোধীদলের নেতা আলেক্সি নাভালনি একটি ভিডিও বার্তায় দাবি করেছিলেন, কৃষ্ণ সাগরে রাজকীয় একটি প্রাসাদের মালিক পুতিন। ক্রেমলিন থেকে গত বছর ওই দাবি অস্বীকার করা হয়েছে।
পুতিনের উপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাকে গত ফেব্রুয়ারিতে ‘অর্থহীন’ বলেছিলেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। পেসকভ বলেছিলেন, “(পুতিন) বেশ উদাসীন একজন মানুষ। তার কিছু সম্পদ আছে ভেবে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা অযৌক্তিক।
“প্রেসিডেন্টের ঘোষণার বাইরে আর কোনো সম্পদ নেই।”কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতারা তা বিশ্বাস করেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর শেলডন হোয়াইটহাউজ কয়েক সপ্তাহ আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘পুতিন এবং তার দেশের ধনকুবেররা অন্যান্য দেশে বিলাসবহুল বাড়ি, সুপার ইয়ট, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য উচ্চ-মূল্যের সম্পদ ক্রয় করে তাদের নোংরা অর্থ জমা করে।”
রক অ্যান্ড রোল ড্যান্সার:
পুতিনের মেয়েরা প্রকাশ্যে কখনও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মেয়ে হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন না। পুতিন নিজেও মেয়েদের বিষয়ে কখেনো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন না।
ফলে পুতিনের পারিবারিক জীবন নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত তথ্য খুব কম পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন নথিপত্র, সংবাদ প্রতিবেদন ও মাঝেমধ্যে প্রকাশিত বিবৃতি থেকে দুই মেয়ের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিন ও তার সাবেক স্ত্রী লুডমিলা দুই মেয়ের বাবা-মা। লুডমিলার সঙ্গে পুতিনের বিয়ে হয় ১৯৮৩ সালে, ওই সময় একজন ছিলেন কেজিবি কর্মকর্তা, অন্যজন বিমানবালা। তাদের ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে ২০১৩ সালে।
বিয়ে বিচ্ছেদ সম্পর্কে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, “এটা যৌথ সিদ্ধান্ত, আমাদের মধ্যে খুব কম দেখা-সাক্ষাৎ হয়, আমাদের দুজনেরই নিজস্ব জীবন রয়েছে।”আর লুডমিলা বলেছিলেন, “তিনি সারাক্ষণই কাজে ডুবে থাকেন।”
তাদের বড় মেয়ে মারিয়া ভরোনৎসোভার জন্ম ১৯৮৫ সালে। সেইন্ট পিটারসবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে জীব বিজ্ঞান এবং মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়ালেখা করেছেন তিনি।
বর্তমানে এনডোক্রাইন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করছেন। শিশুর বৃদ্ধির স্থবিরতা নিয়ে একটি বইয়ের সহলেখক তিনি এবং মস্কোর এনডোক্রাইন রিসার্চ সেন্টারের একজন তালিকাভুক্ত গবেষক।
ভরোনৎসোভা ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। বিবিসি-র অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি একটি কোম্পানির মালিকানার অংশীদার, যে কোম্পানি একটি বিশাল চিকিৎসা কেন্দ্র গড়তে যাচ্ছে।
ডাচ ব্যবসায়ী ইয়োরিত ইয়োস্ত ফাসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো ভরোনৎসোভার। তবে তারা সম্ভবত এখন আলাদা হয়ে গেছেন। ফাসেন এক সময় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রমে চাকরি করতেন।
বিবিসি লিখেছে, ইউক্রেইনে রাশিয়ার সেনা অভিযান শুরুর পর যারা ভরোনৎসোভার সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাবার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে মেয়ের এবং এই যুদ্ধ নিয়ে প্রচারিত আন্তর্জাতিক সংবাদ নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে।
বড় বোনের তুলনায় ছোট বোন কাতেরিনা তিখোনোভা অনেক বেশি জনসম্মুখে থাকেন। তিনি একজন রক এন রোল ড্যান্সার। ২০১৪ সালের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তিনি ও তার নৃত্য সঙ্গী পঞ্চম স্থান অর্জন করেছিলেন।
ওই বছরই তিনি কিরিল শামালভকে বিয়ে করেন, যিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের দীর্ঘ দিনের এক বন্ধুর ছেলে। সেইন্ট পিটারসবুর্গের একটি অভিজাত স্কি রিসোর্টে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। সেখানকার কর্মীরা জানান, বিয়ের দিন বর-বধূ তিনটি সাদা ঘোড়ায় টানা স্লেজে চড়ে সেখানে পৌঁছেছিলেন।
রাশিয়ার জ্বালানি খাতে সম্পৃক্ততার কারণে শামালভের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, বিয়ের পর শামালভের সম্পদের পরিমাণ ‘রাতারাতি বেড়ে যায়’। পরে ওই দম্পতির বিচ্ছেদ হয়।
রাশিয়া ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরু করার পর দুই রুশ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয় বিয়ারিৎজের একটি বিলাসবহুল ভিলা দখলের অভিযোগে, কথিত আছে ওই ভিলার মালিক শামালভ।
কাতেরিনা এখন শিক্ষাঙ্গনে ও ব্যবসায় জড়িত। ২০১৮ সালে একবার তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে উপস্থিত হয়েছিলেন নিউরোপ্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করার জন্য এবং ২০২১ সালে একটি ব্যবসায়িক ফোরামের আলোচনাতেও তাকে দেখা যায়। কোনো অনুষ্ঠানেই তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলেননি।
বিবিসি লিখেছে, দুই মেয়ের কেউই প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে খুব একটা সময় কাটান না।
ভ্লাদিমির পুতিনের নাতি-নাতনিও রয়েছে। ২০১৭ সালে একটি ফোন কলে তিনি তাদের বিষয়টি উল্লেখ করেন, কিন্তু তারা কতজন বা কোন মেয়ের ঘরে কোন নাতি-নাতনি সে বিষয়ে কিছুই বলেননি তিনি।