ক্যাটাগরি

শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল কারাগারে: ‘রাষ্ট্র কি যুক্তি দিয়ে চলছে?’

প্রথমে মামলা, তারপর পুলিশের গ্রেপ্তার এবং তারপর দুটি আদালতে তার
জামিন আবেদন নাকচের ঘটনার পরম্পরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ তানজীবউদ্দিন
খান প্রশ্ন তুলেছেন, রাষ্ট্র কি যুক্তি দিয়ে চলছে?

হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধির ব্যত্যয় চোখে
পড়ছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার চোখে। তিনি সেই সঙ্গে বলছেন, এই
মামলা ‘একাডেমিক ফ্রিডম’র উপর আঘাত।

বিজ্ঞানের বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের মুখে
হৃদয়ের পড়ার এই ঘটনায় শিক্ষকদের তরফে বড় প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন বিজ্ঞান
গবেষকরা।

বিজ্ঞান শিক্ষকের এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি
সংগঠন শিক্ষক নেটওয়ার্ক ‘হতবাক’ হয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা
এখন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েই উদ্বিগ্ন।

হৃদয়
চন্দ্র মণ্ডলকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে। সোশাল
মিডিয়ায় সরব হওয়ার পাশাপাশি রাজপথেও কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন।

হৃদয়
মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে
শিক্ষক। ২২ বছর ধরে ওই স্কুলে বিজ্ঞান ও গণিত পড়িয়ে আসছেন তিনি।

গত
২০ মার্চ দশম শ্রেণির এক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার সময় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের
জবাব দিতে গিয়ে ধর্ম ও বিজ্ঞানের আলাদা হওয়ার কথা বলেন তিনি।

ওই
ক্লাসের কয়েক শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনে তার বক্তব্য রেকর্ড করে। সেই ভিডিও সোশাল
মিডিয়ায় ছড়ানো হলে শুরু হয় আলোচনা।

ওই
শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত আবেদন দেয় কয়েকজন শিক্ষার্থী। ২২
মার্চ বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও স্থানীয় একদল লোক বিক্ষোভও করে এলাকায়।

তখন
পুলিশ গিয়ে বিক্ষুব্ধদের সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হৃদয় মণ্ডলকে তার বাসা থেকে আটক
করে নিয়ে যায়। তাকে চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ওই
রাতেই ওই বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী (ইলেক্ট্রিশিয়ন) মো. আসাদ বাদী হয়ে ধর্মীয়
অনুভূতিতে আঘাত হানার
অভিযোগে মামলা করলে
তাকে সেই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

২৮
মার্চ মুন্সীগঞ্জ বিচারিক হাকিম আদালতে জামিন আবেদন করেন হৃদয়, তা নাকচ করা হয়। এরপর
সোমবার তিনি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবার আবেদন করলেও জামিন হয়নি।

জজ আদালতেও জামিন মেলেনি বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের
 

‘ফাঁসানো হয়েছে’, অভিযোগ হৃদয় মণ্ডলের পরিবারের
 

‘প্রতিবাদটা সবার
করা উচিৎ’

হৃদয় মণ্ডল ‘পরিকল্পিত পরিস্থিতির শিকার’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মশহুরুল আমিন মিলন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমন ঘটনার পর শিক্ষকদের এগিয়ে
আসার কথা ছিল। অনেকেই আসছেন।… ইতোমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় সরব হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু সার্বিকভাবে
বিক্ষোভ হওয়ার কথা ছিল।”

এই ঘটনা দেশে
বিজ্ঞান শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে এ যে
পরিস্থিতিটা সেটা তো আমরা আসলে খারাপ দিকেই যাচ্ছি। যে জায়গায়টা আছি সেখানে
রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষাটাকে এগিয়ে নিতে না
পারি, তাহলে তো রাষ্ট্র হিসেবে আমরা দর্শক হিসেবে থাকব।”

মশহুরুল বলেন, “আমরা বিজ্ঞানকে বুঝিই না। কম্পিউটার
ব্যবহার, স্মার্ট ফোন ব্যবহার, মোবাইলে বিল জমা দেওয়া- আমরা এ জিনিসগুলোকেই মনে
করি আমরা বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হয়ে গেছি। কিন্তু আসলে এটা যে প্রযুক্তির ব্যবহার;
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে পার্থক্যটা, আমাদের সমাজের ভেতরে জানা নেই।”

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বক্তব্য মোবাইলে রেকর্ড করা, তার বিরুদ্ধে একদল
শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ করা এবং তার গ্রেপ্তারের ঘটনাকে পরিকল্পিত মনে করছেন নারী
সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনুও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছাত্র শিক্ষককে
যেভাবে কথা বলেছে, সেভাবে সে বলতে পারে না। ছাত্ররা এ পর্যায়ে চলে গেলে সেটা
আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার।”

কেন সারাদেশের শিক্ষকরা হৃদয়ের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না, প্রশ্ন করেন
তিনি।

মিনু বলেন, “উনি কিন্তু বিষয়ের বাইরে কোনো কথা
বলেননি। বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবেই উনি উত্তর দিয়েছেন। উনি বলেছেন, ধর্মটা
বিশ্বাসের বিষয় আর বিজ্ঞানে প্রমাণ লাগে-যুক্তি লাগে।

“বোঝাই যাচ্ছে, এটা পরিকল্পিত। নইলে ছাত্ররা ক্লাসে কেন মোবাইল নিয়ে
গেল এবং রেকর্ড করল? পুরো বিষয়টাই যে আগে থেকে পরিকল্পিত, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।”

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেপ্তারের দাবিতে স্থানীয় একদলের বিক্ষোভ।

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেপ্তারের দাবিতে স্থানীয় একদলের বিক্ষোভ।

মামলা নেওয়ার ‘এখতিয়ার ছিল না’

ব্যারিস্টার
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ফেইসবুকে লিখেছেন, এই মামলা নেওয়ার এখতিয়ারই মুন্সীগঞ্জ থানা
পুলিশের ছিল না। জামিন কেন হল না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

“শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে
দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় মামলা করার পূর্বে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারার বিধান মতে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল, যা মানা হয়নি।
মুন্সীগঞ্জ সদর থানা মামলা গ্রহণ করারই কোনো এখতিয়ার ছিল না।

“যে অভিযোগে মামলা হয়েছে, তার
সাথে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। এমন এক মামলায় বিজ্ঞ
ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিলেন না কেন, তা বোধগম্য নয়।”

এই আইনজীবী আরও
লিখেছেন, “এই মামলা একাডেমিক ফ্রিডম এর
উপর আঘাত। সব শিক্ষককেই অপমান করা হয়েছে এই মামলার মাধ্যমে।”

আইনজীবী পারভেজ
হাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায় মামলা করার পূর্বে
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারার বিধান মতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার
বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

“তবে পত্রপত্রিকা থেকে যতটুকু
জেনেছি যে, এই ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এখানে দেখা গেছে স্থানীয়দের একটা চাপ ছিল,
কিছু মানুষের ডিমান্ড ফুলফিল করার জন্য এভাবে মামলাটা করা হয়েছে।”

বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি
 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কী বলছেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক তোফায়েল
আহমদ চৌধুরী এক প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধর্মকর্মের
প্রতি আমাদের একধরনের মূল্যবোধ কাজ করে, কিন্তু সেটার সঙ্গে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে
জড়িয়ে সেখানে তাকে বিপদগ্রস্ত করা, এটা কোনো অবস্থাতেই কাম্য না।

“বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে মুন্সীগঞ্জের ওই শিক্ষক যদি ব্যতিক্রম কিছু বলে
থাকেন, তাহলে সেটা উনি ছাত্র-ছাত্রীদের সংশোধন করে দিতে পারেন। তাহলে ব্যাপারটা
সেখানেই শেষ হয়ে যায় । এখানে মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয় আসে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থীরা
নাকি উনার বক্তব্য রেকর্ড করেছে। যদি কোনো উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা
কেন এটা রেকর্ড করে ছড়িয়ে দেবে? এটা  তো একটা বিশাল ক্রাইম।

“এত ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কারা প্রভাবিত করেছে সেটা রেকর্ড
করার জন্য, এটা খতিয়ে দেখার বিষয়।”

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি যে ব্যাখ্যাটা দিয়েছেন, এটার সাথে ধর্মীয় কোনো বিদ্বেষ আছে বলে
আমার মনে হয় না। বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যেরকমটা ব্যাখ্যা দেওয়া উচিৎ, উনি তাই
দিয়েছেন। এটা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতেও পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু সেজন্য মামলা
হবে ? তাহলে একজন শিক্ষকের স্বাধীনতা কোথায়?

“রাষ্ট্র যদি যুক্তি দিয়ে চলত তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের মুক্তি দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের মুক্তি দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক
তানজীমউদ্দিন খান বলেন, “আমরা যদি দোষী খুঁজি, তাহলে দোষ করেছে তারা; যারা এটা রেকর্ড করে
পাবলিক করেছে। কেন এটা অনুমতি না নিয়ে রেকর্ড করে পাবলিক করা হবে? যারা এটা রেকর্ড
করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।”

হৃদয় মণ্ডলের
নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, “ঘটনাটি আমাদের হতবাক করেছে এবং
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি।” 

শ্রেণিকক্ষের ওই
কথোপকথনের লিখিত রূপ পড়ে এবং ওই আলাপচারিতাকে স্বাভাবিক এক বিতর্ক বলেই মনে করছেন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই সংগঠন।

বিবৃতিতে বলা
হয়, “শিক্ষকের দিক থেকে ধর্মীয়
অবমাননার কোনো প্রয়াস তো ছিলই না, বরং যুক্তি দিয়ে, একাডেমিক ভঙ্গিতে
শিক্ষার্থীদের বোঝানোর ও ব্যাখ্যা করার একটি মনোভঙ্গি এতে স্পষ্ট ছিল। তার যুক্তি
ও ব্যাখ্যার ধরন ও মান শিক্ষকসুলভ। যদিও শিক্ষার্থীর দিক থেকে ছুড়ে দেওয়া
প্রশ্নগুলো উদ্দেশ্যমূলক ভাবার অবকাশ রয়েছে। বক্তব্য রেকর্ড করে ছড়িয়ে দেয়া, মামলা
হওয়া ইত্যাদির পরে এ ধারণাটি স্পষ্ট হয়।”

‘সাম্প্রদায়িক
পাঠদানই কারণ’

হৃদয় কৃষ্ণ
মণ্ডলকে গ্রেপ্তারসহ সম্প্রতি বাংলাদেশে সংঘটিত বিভিন্ন ‘সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ’ ঘটনায় উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ
করে বিবৃতি দিয়েছেন ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
আরও বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে।

বিশিষ্টজনদের
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা নিশ্চয়ই একথা সকলে স্বীকার করব যে কোমলমতি
শিশু-কিশোরদের অবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও সাম্প্রদায়িক পাঠদানই আজকের এই বিপর্যয়ের
অন্যতম প্রধান কারণ।

“যে কিশোর ছাত্ররা মৌলবাদী
চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অপমান করে পুলিশে সোপর্দ
করেছে, তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য সংশিল্লষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে
জোর দাবি জানাচ্ছি।”

ওই ঘটনায় পুলিশ
ও প্রশাসনের যারা সহযোগিতা ও ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও
করা হয়েছে।