দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কারাবন্দি এই বিজ্ঞান শিক্ষককে কেন জামিন দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী, অধিকারকর্মী ও আইনের শিক্ষকরা।
তারা বলছেন, আইনি প্রক্রিয়া ‘যথাযথভাবে না মেনে’ একজন শিক্ষককে এভাবে বিচারের মুখোমুখি করলে সাম্প্রদায়িক শক্তিই উৎসাহ পাবে। তখন শিক্ষকদের ‘অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম’ বলে কিছু থাকবে না, তাতে অশিক্ষা আরও বাড়বে।
হৃদয় মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক। ২১ বছর ধরে তিনি ওই স্কুলে বিজ্ঞান ও গণিত পড়িয়ে আসছেন।
যিনি মামলা করেছেন, সেই মো. আসাদ ওই স্কুলের একজন অফিস সহকারী (ইলেকট্রিশিয়ান)। তার করা মামলা পুলিশ নিয়েছে দণ্ডবিধির ২৯৫ এবং ২৯৫/ক ধারায়। ওই দুই ধারায় ধর্মীয় উপসনালয়ের অনিষ্ট করা এবং ধর্ম অবমাননার বিচার হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘ব্লাসফেমি’র ধারায় মামলা করতে হলে আগেই সরকার বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। সেটা ছাড়া কোনো মামলা নেওয়ার এখতিয়ার পুলিশের নাই।
“এখন পুলিশ বলছে, যে দুটি ধারায় মামলা হয়েছে, তার একটিতে অনুমোদন লাগে, আরেকটিতে লাগে না। এখানে আলাদা করার কোনো বিষয় নেই। ১৯৬ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোন কোন ক্ষেত্রে পূর্বানুমোদন নিতে হবে।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, যখনই এ আইনের ব্যবহার করতে হয়, তখন ‘সাংঘাতিক রকমভাবে’ চিন্তা-বিবেচনা করা দরকার। সেজন্যই মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদনের কথা বলা হয়েছে।
“এটা কিন্তু এই কারণেই, যাতে এটার অপব্যবহার না হয়। যখনই পূর্বানুমোদন না নিয়ে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানেই এটাকে আটকে দেওয়া উচিৎ ছিল। এবং আদালতের উচিৎ ছিল একজন নাগরিকের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সে লক্ষ্যে কাজ করা।”
কেন এই মামলা
গত ২০ মার্চ দশম শ্রেণির একটি অনির্ধারিত ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করছিলেন হৃদয় মণ্ডল। সেখানে একজন ছাত্র বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের তুলনা করে কিছু প্রশ্ন করে। হৃদয় মণ্ডল সেগুলোর জবাব দেন। ওই আলোচনা ক্লাসেরই এক ছাত্র মোবাইলে রেকর্ড করে এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
ওই ক্লাসের দুদিন পর কিছু ছাত্র ও স্থানীয় লোকজন মিলে হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে থানায় নিয়ে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
ওই রাতেই স্কুলের অফিস সহকারী আসাদ বাদী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা করলে সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে।
২৮ মার্চ মুন্সীগঞ্জের বিচারিক হাকিম আদালতে জামিন আবেদন করেন হৃদয়, তা নাকচ করা হয়। এরপর সোমবার জেলা ও দায়রা জজ আদালতও তার জামিন নাকচ করে।
রোববার আবার জামিন শুনানি হবে জানিয়ে হৃদয় মণ্ডলের আইনজীবী অজয় চক্রবর্তী বলেন, সেদিন জামিন হবে বলে তারা আশা করছেন।
কী আছে মামলায়?
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল সেদিন ক্লাসে ‘মনগড়া মত প্রকাশ করে’ ইসলাম ও এর পবিত্র গ্রন্থের ‘অবমাননা’ করেছেন এবং ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দিয়েছেন।
পুলিশ যে দুই ধারায় মামলা রেকর্ড করেছে, তার মধ্যে দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোনো ব্যক্তি, এরূপ অভিপ্রায়ে বা এরূপ অবগতি সহকারে জনগণের যে কোনো শ্রেণির উপাসনালয় বা উক্ত শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক পবিত্র বলে বিবেচিত কোনো বস্তু ধ্বংস, অনিষ্ট বা অপবিত্র করে যে, তদ্বারা জনগণের যে কোনো শ্রেণির ধর্মের প্রতি অবমাননা বলে বিবেচনা করার সম্ভাবনা রয়েছে, সে ব্যক্তি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, যার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
আর ২৯৫/ক ধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোনো ব্যক্তি, বাংলাদেশের নাগরিকদের যে কোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার অভিপ্রায়ে স্বেচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষাত্মকভাবে কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর সাহায্যে বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তির সাহায্যে উক্ত শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে বা অবমাননা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, সে ব্যক্তি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, যার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, বা জরিমানা বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
এ দুই ধারার মধ্যে প্রথমটি জামিনযোগ্য হলেও দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ ২৯৫(ক) ’জামিন অযোগ্য’ ধারা বলে জানিয়েছেন হৃদয় মণ্ডলের আইনজীবী অজয় চক্রবর্তী।
তবে ‘জামিন অযোগ্য’ বলা হলেই যে কাউকে জামিন দেওয়া যায় না- বিষয়টি এমন নয় জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “হত্যা মামলার আসামিকেও তো জামিন দেওয়া হয়। এটা একান্তই ম্যাজিস্ট্রেটের স্বীয় ক্ষমতা।
“আবার বলা হচ্ছে, ওই শিক্ষককে জামিন দিলে তার নিরাপত্তার সঙ্কট তৈরি হবে, তাকে মেরেও ফেলতে পারে। এমন যদি হয়, তাহলে তো গুরুতর বিষয়। আইনশৃঙ্খলা যদি না থাকে, তাহলে তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও মামলা হওয়া উচিৎ।”
বাদী কেন অফিস সহকারী?
স্কুলের অফিস সহকারী কেন ওই মামলার বাদী হলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “একজন ইলেকট্রিশিয়ান কীভাবে একটি স্কুলকে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি যদি ব্যক্তিগতভাবে বাদী হতেন, তাহলে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু প্রধান শিক্ষক নিজে না করে কেন তাকে মামলা করতে পাঠানো হল?”
এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকারও সমালোচনা করেছেন স্থানীয় সাংসদ মৃণাল কান্তি দাস। তার অভিযোগ পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ ঘটনা এতদূর গড়িয়েছে।
“একজন শিক্ষক যদি কোনো অপকর্ম করেই থাকে, তাহলে স্কুলে কি হেড মাস্টার নাই? উনি বাদী হতেন। স্কুলের একটা ইলেকট্রিশিয়ান, যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না, সে কী করে এই মামলার বাদী হয়? পুলিশ কীভাবে মামলার এফআইআর লিখে দেয়? পুলিশ কীভাবে তাকে গ্রেপ্তার করল? ওই ইলেকিট্রিশিয়ান জানেও না ওই মামলার মধ্যে কী লেখা আছে। পুলিশ কী করে মামলা লিখে তার স্বাক্ষর নেয়? এর জবাব কে দেবে?“
ক্ষমতাসীন দলের এ সাংসদ বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন বা পুলিশ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে তিনি ‘মর্মাহত, লজ্জিত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ’।
“আমি তো সবটাই জানি, সে একটা ষড়যন্ত্রের শিকার। এর চাইতে বেশি কিছু আমি আর না বলি।”
এ বিষয়ে মামলার বাদী আসাদের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি। তবে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, এই ঘটনা যেন আর বাড়তে না পারে, সেজন্য ‘যথাসাধ্য চেষ্টা’ পুলিশ করেছে।
বিপজ্জনক নজির
যেখানে আইনের ‘অপব্যবহার’ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে হৃদয় মণ্ডলের জামিন না হওয়াকে ‘দুঃখজনক’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক প্রধান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, “ব্লাসফেমি আইনটাই খুব একটা ইতিবাচক আইন নয় আর কী। এবং এমন আইন থাকলে সেই আইনের একটা অপব্যবহারের সুযোগ থাকে।
“যখন এ ধরনের কোনো আইনের প্রয়োগ করা হয় দেশে, প্রয়োগের চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তখন কিন্তু আদালতও এগুলোর ব্যাপারে একটা ধীরগতি এবং খুব দেখেশুনে চলার একটা নীতি অবলম্বন করতে চায়।
“কারণ, এই রকম আইনের প্রয়োগের বা এখানে জামিন দিয়ে কেউ রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হতে চায় না। তারা বুঝতে চায়, রাষ্ট্র কীভাবে দেখবে বিষয়টা।”
আইনের এই শিক্ষক বলেন, “আমরা এখনও মনে করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে একটা শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীর সাথে কী আলোচনা করছেন, সেখানে তাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্য নানা প্রসঙ্গ আসতে পারে এবং সেটার ব্যাখ্যা হতে পারে। এটাকে কখনোই কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিৎ না।
“একজন শিক্ষক যদি অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাজগুলো না করেন, তাহলে তার অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার বিষয়টি সুরক্ষিত থাকাই ভালো। এখানে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, সেই শিক্ষক কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বিষয়গুলো বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, সেখানে একটি অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”
একজন শিক্ষককে এভাবে আটক করা ‘সাংঘাতিক নিন্দনীয়’ মন্তব্য করে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, “যারা এই রকম, শিক্ষকের বিরুদ্ধে বলছেন, কেন বলছেন চিন্তাভাবনা না করে শুধুমাত্র আইনের দোহাই দিয়ে একজনকে হেনস্তা করবেন, এটা কখনোই হওয়া উচিৎ নয়।
“এটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। বন্ধ না হলে আমাদের পড়াশোনা বা মুক্তবুদ্ধির চর্চা হুমকির মুখে পড়বে। এভাবে যদি আইনের অপব্যবহার করা হয়, একজন শিক্ষক ছাত্রকে বোঝাবে কীভাবে?”