সবার সঙ্গে আলোচনা করে তা সমাধানের চেষ্টাও চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মুন্সীগঞ্জের জনপ্রতিনিধির সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম নগরীর জে এম সেন হলে বাসন্তী পূজার মহাসপ্তমীর দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
শিক্ষক হৃদয় চন্দ্রের নাম উল্লেখ না করে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, “আজকে অত্যন্ত দু:খের এবং পরিতাপের বিষয় যে, একটি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তিনি বিদ্যালয়ে পাঠদান করা অবস্থায় সেখানে কী আলোচনা হয়েছে…। সেই পাঠদানের পরিবেশে কী আলোচনা হয়েছে, সেটাকে পুঁজি করে পরিকল্পিতভাবে এমনভাবে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। যেখানে কেউ বলেছে, কেউ শুনেছে, এ ধরনের গুজবের ভিত্তিতে একটি মামলা হল। সেই মামলা কিন্তু রেকর্ডও হল!
“এবং আরও বিষয় যে এ মামলায় সেই শিক্ষককে জামিন দেওয়া হল না। আমি মনে করি, এটা সুবিচার নিশ্চিত করার পথে শুধুমাত্র অন্তরায় নয়। আগামী দিনে যে কোনো কেউ যদি এ ধরনের গুজব তুলে যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তখন সেক্ষেত্রে দেশের বিচার ব্যবস্থা, দেশের পুলিশ প্রশাসন তাদের উপর একটা চাপ সৃষ্টি হবে। যেহেতু একবার এ ধরনের অপপ্রচারের ভিত্তিতে করা অভিযোগ আমলে নিয়ে একজন শিক্ষককে ভুক্তভোগীতে পরিণত করা…। এ প্র্যাকটিসটা একটা অত্যন্ত অসুস্থ ঘটনা।”
এ বিষয়ে ‘সবার সঙ্গে আলোচনা ও সমাধানের চেষ্টা চলছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখানকার জনপ্রতিনিধির সাথেও কথা বলেছি।”
গত ২০ মার্চ মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান পড়ানোর সময় প্রসঙ্গক্রমে শিক্ষার্থীর প্রশ্নে ধর্ম নিয়ে কথা বলেন।
সেই ক্লাসের কথা কয়েকজন শিক্ষার্থী রেকর্ড করে এবং পরে ধর্ম নিয়ে ‘আপত্তিকর’ কথা বলার অভিযোগ তুলে কিছু শিক্ষার্থী ও ব্যক্তি এলাকায় তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। ওই অবস্থায় এ শিক্ষককে মুন্সীগঞ্জ সদর থানা পুলিশ নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়।
ঘটনার দুদিন পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী (ইলেক্ট্রশিয়ান) মো. আসাদ বাদী হয়ে হৃদয় চন্দ্রের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। ২৩ মার্চ তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করলে জেল হাজতে পাঠানো হয়। পরে জামিন আবেদন করা হলেও মুন্সীগঞ্জ বিচারিক হাকিম এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তার জামিন হয়নি।
এ পরিস্থিতির নেপথ্যে অতীতের সামাজিক ‘কুশিক্ষার’ প্রভাব দেখছেন উল্লেখ করে নওফেল বলেন, “বই খাতাতে যাই লেখা থাকুক না কেন সামাজিক প্রেক্ষাপটে যে শিক্ষা অতীতে দেওয়া হচ্ছিল…। যে মানুষে মানুষে কারা বেশি ভালো, কারা শ্রেষ্ঠ, কারা সর্বোত্তম- এ একটা কুশিক্ষা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে।
“যার কারণে সমাজে এই যে বিভাজন দেখছি। শঙ্কা দেখছি, ভীতি দেখছি। শুধু শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে মনে করি না এগুলো দূর করা সম্ভব। বিশাল সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল শক্তিকে শক্তিশালীভাবে সেই সামাজিক আন্দোলনে নামতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।”
তিনি বলেন, “কারণ এর থেকে পিছপা হলে বাংলাদেশ কিন্তু পাকিস্তানে পরিণত হবে। এবং বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানে পরিণত হয় সেটা নির্ঘাত আফগানিস্তানে রূপান্তরিত হবে।
“এ বিষয়টা আমাদের সকল পর্যায়ে মাথায় রাখতে হবে যদি ঐক্যবদ্ধভাবে সবার সমান অধিকার, সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক অধিকার প্রশ্নে কিন্তু বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না।”
শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, “আমি মনে করি দেশে একটা বিশাল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন। যেখানে এখন ধর্মে ধর্মে বিভাজনের নোংরা রাজনীতি এবং সময় আসলেই নিজেকে অতিমাত্রায় শক্তিশালী প্রমাণের যে অপচেষ্টা। শ্রেষ্ঠত্ববাদী যে আলোচনা। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বিভিন্ন সময় অপপ্রচারকারীরা যে ধর্মের মনগড়া অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ তা সামাজিক অস্থিতরতার সৃষ্টি করছে।
“আমরা এ বিষয়টা এর আগে বারবার বলেছি। কেউ কেউ রাষ্ট্রবিরোধী, সংবিধানবিরোধী ও ধর্মের মনগড়া নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে ওয়াজ করছে…। আমরা দেখেছি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এমন নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ সবকিছুকে ঠুনকোভাবে তুলে ধরে। এটা পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে সুবর্ণজয়ন্তীতে রাজনীতিতে এ ধরনের ব্যক্তিদের আমাদের দেখতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “একটা বিষয় আশ্বস্ত করতে চাই যে, এ বাংলাদেশ- আমার, আপনার, ওদের সকলের। দেশের প্রতিটি নাগরিকের দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটির উপর অধিকার আছে। সুতরা আমার অধিকার কেউ যদি কেড়ে নিতে চায়…। আমার ধর্ম চর্চার অধিকার, আমার পূজা করার অধিকার, আমার এবাদত করার অধিকার কিন্তু কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আত্মবিশ্বাসের সাথে দেশের নাগরিক হিসেবে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস চর্চা করব। এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
“তবে কোনো ধরনের ঠুনকো যুক্তিকে, যদি অন্যের ধর্মীয় উৎসব দেখলেই কারও মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগছে বলে মনে হয়; সেটাকে ধর্মীয় অনুভূতি বলা যায় না। এটা পরিকল্পিতভাবে নিজেকে শোষকের ভূমিকায় নিয়ে আরেকটি সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের একটা নির্লজ্জ চেষ্টা।”
পরিকল্পিতভাবে এসব করা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাদের লক্ষ্য একটাই যে কোনোভাবেই বাংলাদেশে আমাদের যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে ঐতিহ্য, যে বৈচিত্র্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির মূল বিষয়গুলো এখান থেকে বিদায় করে দেওয়া। এটাকে কোনোভাবে একটা পাকিস্তানের মত কট্টর সমাজে পরিণত করা। দীর্ঘদিন ধরে এ প্রচেষ্টা চলে আসছে।“
তিনি বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষ অসম্প্রাদায়িক বাংলাদেশের স্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে আজ আমাদের এই ১৩ বছরের পথচলা। ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমাদের ধরে রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে।
অনুষ্ঠানে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল কারাগারে: ‘রাষ্ট্র কি যুক্তি দিয়ে চলছে?’
হৃদয় চন্দ্র মুক্তি না পেলে ‘আমাকেও গ্রেপ্তার করা হোক’: জাফর ইকবাল
জজ আদালতেও জামিন মেলেনি বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের
‘ফাঁসানো হয়েছে’, অভিযোগ হৃদয় মণ্ডলের পরিবারের
বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে নিয়ে মন্তব্য: সমালোচনার মুখে ঢাবির শিক্ষক নেতা বললেন, তিনি ‘প্রগতির পক্ষে’