সেই হাঁকেই গত মঙ্গলবার একটি দোকানে ভিড়েছিলেন জেসমিন আক্তার। চকবাজারের ইফতারে রসনা তৃপ্ত করতে ছেলেকে নিয়ে লালমাটিয়া থেকে এসেছিলেন এই গৃহবধূ।
‘বড় বাপের পোলায় খায়’ হাঁকডাকে এগিয়ে যান মোহাম্মদ হোসেনের দোকানের সামনে।
খাবারটি দেখে জেসমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাম শুনে ভেবেছিলাম সম্ভবত বড় কোনো খাবার। আস্ত খাসি দিয়ে তৈরি বড় কিছু বা অন্য কোনো খাবার।
“কিন্তু এখন দেখছি, হাতে মাখানো নামমাত্র কিছু মাংস, ডাল সিদ্ধের সঙ্গে চিড়া ভাজা আর তেলতেলে কিছু লালচে পোড়া মসলা। এই হল বড় বাপের পোলায় খায়! কী ভেবেছি আর কী খাবার এটি!”
একটু জোরেই বলছিলেন জেসমিন, তা শুনে চকবাজারের শাহী মসজিদের সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়া স্থানীয় এক ব্যক্তি বলে উঠলেন- ‘সবই ভুয়া’।
প্রথম রোজায় রোববার পুরান ঢাকার চকবাজারে ইফতার বেচাকেনা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
চকবাজার শাহী মসজিদের সামনের সড়কের ইফতারির অস্থায়ী অন্তত একশ দোকান রয়েছে। তার মধ্যে দুটি দোকানে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ পাওয়া গেল।
দোকান দুটির অন্তত ১৫ জন কর্মচারী ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙায় ভইরা নিয়া যায়’ চিৎকারে মাতিয়ে তুলছিল বাজার।
তাও ভুয়া কেন? এই প্রশ্নে চকবাজারের চুড়িহাট্টার বাসিন্দা আবুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, বিভিন্ন খাবারের উপাদান দিয়ে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ প্রথম বানানো শুরু করেছিলেন কামাল ব্যাপারী নামে একজন ব্যক্তি। কিন্তু এখন যারা বিক্রি করছেন, তারা কেউই তার কাছ থেকে শেখেনি।
কামাল ব্যাপারীর সেই খাবার একসময় বেশ জৌলুসপূর্ণ ছিল বলে জানালেন চকবাজারের বাসিন্দা আনোয়ার নামে ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি।
নামকরণ নিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কামাল ব্যাপারীর বড় ছেলে এই খাবার বিক্রি করত বলেই এই নামটি এসেছে। তবে ৩০ বছর আগে কামাল ব্যাপারী মারা যাওয়ার পর তার ছেলে আর এই ব্যবসাটি চালিয়ে নেননি। এই ফাঁকে কিছু মানুষ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রমজানে মানুষকে ঠকাচ্ছে।
ঠকানো কেন বলা হচ্ছে- আনোয়ার যুক্তি দেখান, “৩৫-৪০ বছর আগে এই খাবার বাসায় নিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খেতাম। খেতে ভালো লাগত। এখন যারা বিক্রি করছে, তারা কারা? কোথা থেকে ১০ থেকে ১২ রকম মসলা বানানো শিখেছে তারা?”
বাশার বলেন, ছোট বেলায় আমার বাপ-চাচারা ঠোঙায় ভরে যখন আনত তার ঘ্রাণই ছিল আলাদা। সবই ছিল ঘি দিয়ে ভাজা। এখন তা নেই।
দালিলিক কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও চকবাজারের বাসিন্দা আরও কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলে তারাও ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ খাবারটির প্রচলনের সঙ্গে কামাল ব্যাপারীর নাম জড়িত থাকার কথাই বলেন।
রোজার প্রথম দিন রোববার পুরান ঢাকার চকবাজারে জমে ওঠে ইফতার কেনাকাটা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এখানে আসে ইফতার কিনতে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
এখনকার বিক্রেতাদের নিয়ে বাশার বলেন, মোহাম্মদ হোসেন অন্য সময় চকবাজার শাহী মসজিদের সামনে তালসহ বিভিন্ন ফল বিক্রি করেন। আর রোজা এলেই ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙায় ভইরা নিয়া যায়’ বিক্রি করেন।
স্থানীয়রা নেতিবাচক বললেও এ দুটি দোকানেই ক্রেতার ভিড় ছিল বেশ।
ইফতার: চকের ‘ঐতিহ্য’ এখন ‘মৌসুমিদের’ কব্জায়
দোকানি মোহাম্মদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১২টি পদ দেওয়া হয় এই খাবার তৈরিতে। সব ধর্মের মানুষের খাবারের জন্য গরুর মাংস বাদ দেওয়া হয।
তিনি কোয়েলের মাংস ও কলিজা, খাসির কলিজা, মগজ, দেশি মুরগির ডিম ও বিভিন্ন রকম মসলা দিয়ে তৈরি করে এই খাবার প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
খাবারের নামকরণ নিয়ে জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হোসেন বলেন, সেটা তার জানা নেই। তবে পাকিস্তান আমলে এক ধরনের ভর্তা তৈরি হত। সেই ভর্তার থেকেই এই নাম এসে থাকতে পারে।
রোজায় ইফতারের মজাদার আইটেম চকবাজারের ‘বড় বাপের পোলায় খায়’।
আরেকটি দোকানের মালিকের নামও হোসেন। অন্য সময় তিনি পানির ব্যবসা করেন। এই রমজানে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বিক্রি শুরু করেছেন।
কোথায় এসব খাবার তৈরি করেন- এমন প্রশ্নে কিছুটা ‘দ্বিধাগ্রস্ত’ হয়ে বলেন, “একটা জায়গা ভাড়া নিয়েছি।”
ঢাকায় ব্যাপক পরিচিতি পেলেও ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ খাবারটি কতটা স্বাস্থ্যকর, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
পুরান ঢাকারই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এখন ওই কলেজের গ্যাসট্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই খোলা খাবার থেকে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতেই পারে। ফলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কাও বেশি।
‘বড় বাপের পোলায় খায়’ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি হেসে বলেন, “পুরান ঢাকার সবকিছুই জানি। চকবাজারের ইফতারি তো ছাত্রজীবন থেকে দেখছি।
“এই খাবারটি খোলা খাবার এবং ফুটপাতের উপর শুধু বিক্রি করা হয় না, বিভিন্ন জিনিস মাখানোও হয় তাৎক্ষণিকভাবে ফুটপাতে দাঁড়িয়েই। বিক্রেতারা জোরে জোরে চিৎকার দেন ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বলে। সুতরাং মুখ থেকে ….”