নববর্ষ ও ঈদ সামনে রেখে দর্জিবাড়ির সেলাই মেশিন এখন দিনরাত ঘুরছে। বাহারি রঙের কাপড়ে বসছে জরি, চুমকি। কেউ পোশাক আয়রন করছেন, কেউ ভরছেন প্যাকেটে। নগরীর ঘাটফরহাদবেগে গলির ভেতর সারি সারি কারখানাগুলোতে দারুণ ব্যস্ততা।
প্রতিবছরই এ সময়টার অপেক্ষায় থাকে খলিফাপট্টি, তবে মহামারীতে গত দুবছর এই ব্যস্ততা ছিল না, পণ্ড হয়ে গিয়েছিল পোশাকের ব্যবসা।
পুঁজির অভাবে ব্যবসা গুটিয়েও এনেছেন অনেকে
এ গলির সজীব গার্মেন্টেস নামের একটি দোকানের মালিক জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি এখন। এ বছর বিক্রিও ভালো হচ্ছে। চেষ্টা করছি কম লাভে বেশি বিক্রি করে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে।”
তবে সবার অবস্থা জাহাঙ্গীরের মত নয়। মহামারীর সময় হওয়া দেনার চাপে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে এনেছেন, কাজের পরিসর করেছেন ছোট।
আগে খলিফাপট্টিতে সাড়ে চারশর বেশি দোকান ও কারখানা ছিল; মহামারীর ধাক্কায় অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলায় এখন সব মিলিয়ে আড়াইশর মত কারখানা আছে বলে ভাষ্য ব্যবসায়ীদের।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আইয়ুব আলী সওদাগর নামের এক দর্জিসহ কয়েকজন কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে এসে ঘাটফরহাদবেগে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে ওই এলাকার নামই হয়ে যায় খলিফাপট্টি।
খলিফাপট্টি ছোট ছোট দোকানঘরে দিনরাত মেশিন চালাচ্ছেন দর্জিরা
সারাবছর কাজ চললেও শবে বরাতের আগ থেকে মূল ব্যস্ততা শুরু হয় খলিফাপট্টিতে। কারিগরদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় সব বয়সের মানুষের পোশাক।
এখানকার কারখানার তৈরি পোশাক পৌঁছে যায় চট্টগ্রামের বিপণি বিতান, পাহাড়ের তিন জেলা, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় মার্কেট ও পোশাকের দোকানে।
মহামারীর প্রথম বছরে তেমন কাজ জোটেনি এখানবার কারিগরদের, আর গত বছর ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে ঈদ বাজার খুলেছিল শর্ত সাপেক্ষে, তাই আশানুরূপ ব্যবসা হয়নি।
পোশাকে জরি লাগাচ্ছেন খলিফাপট্টির কারিগররা
তবে এবার রোজার শুরুতেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পোশাকের ব্যবসায়ীরা এসে মালামালা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানালেন সজীব গার্মেন্টেসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম।
এ দোকানে ছেলেদের শার্ট ও মেয়েদের জামা তৈরি হয়। ইতোমধ্যে সাত থেকে আট হাজার শার্ট, পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেয়েদের ওয়ানপিস বিক্রি হওয়ার কথা জানালেন জাহাঙ্গীর।
এসএ আহাদ গার্মেন্টসের মালিক আব্দুল আহাদও মহামারীর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছেন।
দিনরাত এক করে সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত খলিফাপট্টির দর্জিরা
তিনিও বললেন, “এখানকার অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে। আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা এসে মালামাল কিনে নিয়ে গেছেন। অনেকে এখনও আসছে। সবমিলিয়ে গত ২ বছরের চেয়ে এবার বেচাবিক্রি ভালো।”
দুই বছরে ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে ‘নিলু ফ্যাশন’ কারখানার মালিক নুরুল আলম বললেন, আগে তার আলাদা ‘শো-রুম’ ছিল, লোকসানের মুখে সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন, কারখানায় শ্রমিক কমিছে এনেছেন।
“করোনার আগে আমার কারখানায় ছিল ২২ জন শ্রমিক। এখন আছে মাত্র তিনজন। লোকসানের কারণে ২৭ বছরের পুরানো ব্যবসা অনেকটা ছোট করে এনেছি।”
দুই বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ব্যবসা চালু করতে ঋণ চান ব্যবসায়ী-দোকানীদের অনেকে
নুরুল আলম জানালেন, ২০২০ সালে ঈদেরর জন্য আগে থেকে পোশাক তৈরি করে রেখেছিলেন। কিন্তু পরে লকডাউনে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেল। ফলে বিক্রি হয়নি কিছুই। পরে বাধ্য হয়ে সেগুলো তিনি ‘অকশনে’ বিক্রি করেন।
“গতবছর ১২ রমজান থেকে মার্কেট খুলেছিল। কিন্তু পাইকারী ব্যবসায়ীরা মালামাল নেয়নি। খুচরা ব্যবসায়ীরা অল্প অল্প মালামাল কিনেছিল, তাতে ব্যবসা হয়নি।”
যাদের কাছ থেকে কাপড় কিনে আনতে হয়, সেখানে অনেক টাকা দেনা হওয়ায় এবার তেমন কোনো পোশাক বানাতে পারেননি বলে জানালেন এই ব্যবসায়ী।
খলিফাপট্টিতে কারিগরদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে সব বয়সের মানুষের পোশাক।
সরকারের কোনো প্রণোদনাও পাননি দাবি করে নুরুল আলম বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেলে আবার হয়ত পুরোদমে কারখানা চালাতে পারবেন।
একই ধরনের কথা বললেন খলিফাপট্টি বণিক কল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ।
তিনি বলেন, “মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা কোনো সরকারি প্রণোদনা কিংবা সহায়তা পাইনি। যদি কোনো ব্যাংক কিংবা ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আমাদের ঋণ দিয়ে সহায়তা করে, তাহলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।”
প্রতিবছর ঈদের ব্যস্ততা ঘিরে কারিগরদের পাশাপাশি কিছু ‘মৌসুমি কারিগর’ খলিফাপট্টিতে আসেন কাজের আশায়। বছরের অন্য সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় তারা কাজ করেন। তবে ঈদের আগে চাহিদা বাড়ে বলে তারা চলে আসেন বন্দরনগরীতে।
খলিফাপট্টিতে কাজ করেন নানা বয়সী শ্রমিক
এ বছরও মৌসুমি কারিগররা এসেছেন, তবে তাদের সংখ্যা কম বলে ব্যবসায়ীরা জানালেন।
এসএ আহাদ গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছেন গাজীপুরের কালীগঞ্জ থেকে আসা মো. ইউসুফ। তিনি দর্জির কাজ করেন।
ইউসুফ বললেন “এখানে মাস খানেক কাজে অন্য সময়ের তুলনায় রোজগার ভালো হয়। তাই শবে বরাতের আগে চট্টগ্রামে আসি, ঈদের পর আবার বাড়ি ফিরে যাই।