গত চারদিন ধরে নদ নদীর পানি কমলেও আগে থেকে হাওরের অস্থায়ী কাঁচা ফসলরক্ষা বাঁধগুলো ঢলের পানির সঙ্গে লড়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ফাটল দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। কোথাও কোথাও পুরনো বাঁধও দেবে যাচ্ছে।
বাঁধগুলো সংস্কার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী শ্রমিকরা। চারদিকে পানি থাকায় বাঁধের পাশে মাটি মিলছে না। ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না।
দশদিন ধরে মেঘের লুকোচুরির মধ্যে আবারও এক সপ্তাহ ভারি বৃষ্টিপাতে নদ-নদীর পানির বিপৎসীমা অতিক্রম করার কথা জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থাসমূহ থেকে প্রাপ্ত বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস পর্যালোচনা করে তাদের আবহাওয়া ও বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে ১০ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাভাবিক থেকে বেশি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে উত্তরপূর্ব ভারতের বরাক অববাহিকায়। এছাড়া মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে ভারি বৃষ্টিপাতও হবে। ফলে সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা, বৌলাই, কংস, সোমেশ্বরীতে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
এই পূর্বাভাস সত্যি হলে এবং নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলে হাওরের ফসল টিকানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ মনিটরিং কমিটির সদস্য সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন বলেন, গত দশদিন ধরে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বেড়িবাঁধগুলোর বেশিরভাগ পানিতে নিমজ্জিত থাকায় দেবে যাচ্ছে।
“শুধু নতুন বাঁধই নয় গেলবারের পুরাতন বাঁধগুলোও ধসে যাচ্ছে। এতে আপৎকালীন বাঁধরক্ষা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। তাছাড়া শ্রমিক ও মাটি না পাওয়ায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ টিকানো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কাঁচা মাটির এই বাঁধগুলো দশদিন ধরে পানিতে থাকার ফলে এখন ধস নামছে। মাটি দেবে যাওয়ায় স্থানে স্থানে ফাটল দেখা দিচ্ছে।”
বাঁধগুলো নিয়ে প্রশাসন নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে জানিয়ে তিনি জানান, তাহিরপুর উপজেলার গুরমার হাওরের ২৩, ১১, ৪৪ প্রকল্পগুলোর পুরাতন বাঁধও ধসে যাচ্ছে। পানিতে নিমজ্জিত থাকায় এবং বৃষ্টিপাত হওয়ায় মাটি দেবে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে ধান কাটা শুরু হওয়ায় সংস্কারকাজ ও তদারকি করতে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। মিলছে না মাটি। বৈরী আবহাওয়া ও ঝড়ো বৃষ্টির কারণে বাঁধের নিচ দিয়ে ফাটল দেখা দিচ্ছে। এতে বাঁধ ঝুঁকিতে পড়েছে। এছাড়া বাঁধগুলো লোকালয় থেকে দূরে থাকায় ও দুর্গম অবস্থানের কারণে বাঁশ, মাটি-বালু সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত হাওরের ফসল বড় দুর্যোগের মুখে না পড়লে শতকরা ৮০ ভাগ ধান গোলায় তুলতে সক্ষম হবেন কৃষক।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম জানান, হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের উচ্চতা ৬.৫ ফুট। এখন নদী পানিতে টইটম্বুর। কিন্তু হাওর পানিশূন্য। তাই স্বাভাবিকভাবে নদীর পানির চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে।
“তবে সর্বশেষ আবহাওয়া অধিদপ্তর যে পূর্বাভাস দিয়েছে তা সত্যি হলে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইবে। বাঁধগুলো তলিয়ে হাওরের ফসলও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, এ পর্যন্ত ১৪টি হাওরের ৫ হাজার ১৫ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। রোববার পর্যন্ত কাটা হয়েছে ২ হাজার ৬০২ হেক্টর জমির বোরো ধান; যার গড় কর্তন ১.৫ হেক্টর।
প্রতিদিনই ধান কর্তন বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৮০ ভাগ ফসল কর্তন করা সম্ভব।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান শনিবার বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করে হাওরে এখন সংকটকাল চলছে বলে মন্তব্য করে সবাইকে একযোগে এর মোকাবেলা করার আহ্বান জানান।
বর্তমানে জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজন ও স্বেচ্ছাশ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোতে কাজ করছেন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তারা।
মন্ত্রী মান্নান বলেন, “আমরা হাওরবাসী প্রকৃতির কাছে অসহায়। আমাদের পূর্ব পুরুষরাও এভাবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে কৃষি ব্যবস্থাকে সচল রেখেছেন। তবে তাদের সময়ের তুলনায় এখন আমাদের কৃষি অনেক আধুনিক। সহজে ধান কাটা ও মাড়াই করা যায়। তারপরও বৈরী প্রকৃতি আমাদের দুর্যোগের মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রকৃতি আরো কয়েকটা দিন দিলে আমাদের কৃষকদের কষ্টের ফসল গোলায় তোলা সম্ভব।”
তিনি এই সংকটকালে ঘরে বসে না থেকে প্রশাসনসহ সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
এর আগে বৃজস্পতিবার [৭ এপ্রিল] হাওর পরিদর্শনে এসেছিলেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম।
ওইদিন তিনি বলেছিলেন, গত ১ এপ্রিল থেকে কয়েকদিন মেঘালয়ে ১২০৯ মিলিমিটার রেকর্ড বৃষ্টিপাতে পাহাড়ি ঢল সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি উপচে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে আঘাত করছে।
তিনি ফসলরক্ষা বাঁধগুলোতে তদারকি ও নজরদারির নির্দেশনা দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টদের।
হাওরের ফসলডুবি: ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসলডুবির ঘটনা তদন্তে সুনামগঞ্জে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
রোববার সন্ধ্যায় হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এই কমিটি করে দেন। কমিটিকে দ্রুত সময়ে প্রতিবেদন জমাদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, পাঁচ সদস্যের কমিটির প্রধান করা হয়েছে সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেনকে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সুমন মিয়া, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম।
আরও পড়ুন
বৃষ্টি আসছে, হাওরে ফের বন্যার শঙ্কা
হাওরপাড়ে উপমন্ত্রী, শুনলেন অনিয়মের অভিযোগ