সোমবার নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে ভোটের জন্য পার্লামেন্ট অধিবেশন ফের শুরুর পর একটি নতুন সরকার গঠিত হবে, সম্ভবত বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফের অধীনে।
২২ কোটির বেশি মানুষের দেশ পাকিস্তান। দেশটির পশ্চিমে আফগানিস্তান, উত্তরপূর্বে চীন এবং পূর্ব সীমান্তে ভারতের অবস্থান। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে।
ওদিকে জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের মিত্রতার সম্পর্ক অটুট। কিন্তু ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসে মিত্রতার সেই ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটনা ইমরান। যুক্তরাষ্ট্র নয়, তিনি বরং চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে বেশি আগ্রহ দেখান।
অথচ যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে নিজেদের সব থেকে বড় শত্রু মনে করে চীনকে। বিশ্বজুড়ে মোড়লিপনা থেকে শুরু করে অর্থ-বাণিজ্য বা সামরিক শক্তি, সব ক্ষেত্রেই দুই দেশ পরষ্পরের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী।
তাই ইমরান যখন বার বার আমেরিকার সমালোচনা করে নানা বক্তব্য দিয়েছেন, চীন ঘনিষ্ঠ হওয়ার এবং হালে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সেটা পছন্দ হওয়া কথা না।
তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইমরানের অভিযোগের তীরও যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করে তখন মস্কো সফরে ছিলেন ইমরান। তার ওই সফর যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করেছে বলে দাবি করেছেন খোদ ইমরান।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাকিস্তানের বৈদেশিক এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত ঐতিহ্যগতভাবে দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর হাতে।
এই দুই ক্ষেত্রে যাবতীয় নীতি এবং কৌশল সেনাবাহিনীই নির্ধারণ করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ইমরান জনসম্মুখে বক্তৃতায় এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা পাকিস্তানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দেশের সম্পর্কে তীব্র প্রভাব ফেলেছে।
আফগানিস্তান
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে। তালেবান আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরেছে। অর্থের অভাব ও আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার কারণে দেশটি অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে। কাতারই এখন তালেবানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অংশীদার।
ইন্দো-প্যাসিফিক সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক লিসা কার্টিস বলেন, ‘‘তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যম হিসেবে পাকিস্তানকে আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। কাতার এখন সেই ভূমিকায়।”
এছাড়া, তালেবান ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তের কাছে হামলায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তান: অনেক নাটকের পর আস্থাভোটে ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খান
পাকিস্তান চায়, তালেবান চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে আরও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। তাদের আশঙ্কা, চরমপন্থিরা পাকিস্তানে সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে পারে। যেটা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে, মানবাধিকার প্রশ্নে অধিকাংশ বিদেশি নেতার তুলনায় ইমরান খান তালেবানের সমালোচনা কম করেছেন।
চীন
ইমরান খান বারবারই জোর দিয়ে পাকিস্তান এবং বাকি বিশ্বের উপর চীনের ইতিবাচক ভূমিকার কথা বলে এসেছেন। তবে শুধু ইমরান নন বরং বর্তমানে তার বিরোধী দলে যারা আছেন তাদের আমলেও চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক ছিল।
চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) নামে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রকল্পের যে চুক্তি দুই প্রতিবেশীর মধ্যে হয়েছে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা এবং উদ্বোধন হয়েছে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার সময়। এ দুই দলই ইমরানকে পাকিস্তানের ক্ষমতা থেকে সরাতে মূল ভূমিকা রেখেছে, নতুন সরকারে ক্ষমতা ভাগাভাগিও করতে পারে দল দু’টি।
পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশের নেতা হিসেবে চীনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ, যার এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক লোকদেখানোর বিষয়টি এড়িয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পাওয়ার ক্ষেত্রে তার সুনাম বেইজিংয়ের জন্য সুসংবাদ হয়ে উঠতে পারে।
ভারত
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান তিন তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখণ্ড কাশ্মীর নিয়ে।
আফগানিস্তানের পাশাপাশি স্পর্শকাতর এই এলাকা পরিচালনার নীতিও নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তবে বর্তমানে বিশেষ করে ২০২১ সালের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীরের ডি-ফ্যাক্টো সীমান্তে উত্তেজনার মাত্রা সবচেয়ে কম পর্যায়ে রয়েছে।
যদিও গত কয়েক বছর ধরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনও কূটনৈতিক সংলাপ হয়নি। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম ভারতে মুসলমান সংখ্যালঘুদের উপর হামলার নানা ঘটনা সামাল দেওয়াকে কেন্দ্র করে ইমরানের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তীব্র সমালোচনা করা।
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক করন থাপার, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর নজর রাখছেন। তিনি বলেন, কাশ্মীরে একটি সফল অস্ত্রবিরতি বাস্তবায়নের জন্য ইসলামাবাদে নতুন বেসামরিক সরকারের ওপর চাপ দিতে পারে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
পাকিস্তান: যে দেশে মেয়াদ শেষ করতে পারেননি কোনো সরকারপ্রধান
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, যদি ভারত রাজি থাকে তবে তার দেশ কাশ্মীর ইস্যুতে সামনে আগ্রসর হতে প্রস্তুত আছে। তাছাড়া, এ ইস্যুতে বছরের পর বছর ভারতকে কয়েকটি আলোচনা প্রস্তাব দেওয়ার অগ্রভাগে রয়েছে শরিফের রাজনৈতিক পরিবার।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভেতরে ব্যাপক বিক্ষোভ কিংবা ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি না পেলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ, তিনি এখন ইউক্রেইন যুদ্ধ সামলাতে ব্যস্ত।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রবিন রাফেলও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এখন মনোযোগ দেওয়ার মত আরও অনেক বিষয় আছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক কার্টিস বলেন, ‘‘যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আফগানিস্তান, ভারত ও পারমাণবিক অস্ত্রের মত বিষয়ে কোনও নীতি বা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র সেটা গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে কী হচ্ছে যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপ্রাসঙ্গিক।”
কোনো কোনো রাজনীতি বিশ্লেষক এও বলেছেন, যেহেতু পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকে দেশটির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ন্ত্রণ করে, তাই সেখানে সরকারের পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় কোনও উদ্বেগের বিষয় নয়।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ মার্কিন পরিচালক কার্টিস বলেন, ইমরান খানের মস্কো সফর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘বিপর্যয়’ ছিল এবং ইসলামাবাদে একটি নতুন সরকার অন্তত এ সম্পর্ক মেরামতে সহায়ক হতে পারে।
ইমরান খান বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে এসেছেন।বলেছেন, তার সাম্প্রতিক মস্কো সফরের কারণে ওয়াশিংটন তাকে অপসারণ করতে চেয়েছে। তবে ওয়াশিংটন এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।