সেই সঙ্গে হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে দায়ের করা ধর্ম অবমাননার মামলার স্থায়ী নিষ্পত্তি এবং তিনি যাতে স্বাভাবিকভাবে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারেন, তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
হৃদয় মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক। দুই দশক ধরে তিনি সেখানে বিজ্ঞান ও গণিত পড়িয়ে আসছেন।
শ্রেণিকক্ষের আলোচনার সূত্র ধরে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা করা হয়। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত ১৯ দিন ধরে তিনি কারাগারে ছিলেন।
মুন্সীগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক অতিরিক্ত জেলা জজ মোতাহারাত আক্তার ভূইয়া রোববার হৃদয় মণ্ডলের জামিন মঞ্জুর করেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকালে কারামুক্ত হন এই শিক্ষক।
দুপুরে জামিন শুনানির পর আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন ববিতা। স্বামীর জামিনের জন্য সবার তাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এই নার্স।
তিনি বলেন, “এতদিন আমার স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে রাখা হয়েছে। তখন আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। বিপন্ন ছিল আমার পুরো পরিবার। এক একটা দিন মনে হয়েছে এক একটা বছর। আমার ছেলেমেয়েরা তার বাবার জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করেছে।”
১৯ দিন পর জামিন পেলেন শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল গ্রেপ্তার: ঘটনার পূর্বাপর
আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ববিতা বলেন, “আমি রায়ে অনেক খুশি। আমার স্বামী সসম্মানে মুক্তি পেয়েছে, সেজন্য যারা আমাদের পাশে ছিলেন সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার স্বামী বাসায় যাওয়ার পর আমাদের নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা করা হোক, আমি সরকারের কাছে এই আবেদন করছি।”
গত ২০ মার্চ দশম শ্রেণির একটি অনির্ধারিত ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করছিলেন হৃদয় মণ্ডল। সেখানে একজন ছাত্র বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের তুলনা করে কিছু প্রশ্ন করলে সেগুলোর জবাব দেন হৃদয়।
ক্লাসের এক ছাত্র ওই আলোচনা মোবাইলে রেকর্ড করে এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুদিন পর কিছু ছাত্র ও স্থানীয় লোকজন মিলে হৃদয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে থানায় নিয়ে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ হৃদয়কে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
ওই রাতেই স্কুলের অফিস সহকারী আসাদ বাদী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা করলে সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে।
এ ঘটনায় শিক্ষাবিদ, অধিকারকর্মী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এর প্রতিবাদে সরব হয়। শ্রেণিকক্ষের আলোচনা এভাবে গ্রেপ্তারে গড়ালে দেশে বিজ্ঞান শিক্ষকদের কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে সতর্ক করেন কেউ কেউ। স্কুল কর্তৃপক্ষ বা পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
‘স্কুলের কিছু মাথা বাচ্চাদের ফুসলিয়েছে’: হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলার ধারা ও জামিন না হওয়ায় প্রশ্ন
ববিতা বলেন, “আমার স্বামী যেন আবার আগের মত স্কুলে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা যাতে করা হয়। সেই সাথে মামলাটির একেবারে নিষ্পত্তি যেন করা হয়।”
টিউশনিতে হৃদয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ‘বেশি’ হওয়ায় অন্য শিক্ষকদের কেউ কেউ তাকে ‘পছন্দ করত না’ এবং এর আগেও হৃদয়ের ওপর দুবার ‘হামলা’ হয়েছে বলে জানান ববিতা। তিনি বলেন, এ সব ব্যাপারে কখনও আলোচনা করতেন না তার স্বামী।
ববিতা বলেন, তার স্বামীর ওপর প্রথম হামলা হয় বছর দুয়েক আগে, টিউশনি থেকে বাসায় ফেরার পথে। সর্বশেষ মাস দেড়েক আগেও হামলাকারীরা হৃদয়ের গায়ে ইটের টুকরো ছুড়ে মারে, ঘরে দরজায় লাথিও মারে।
“তাছাড়া, প্রায়ই দরজায় লাথি মেরে ‘মণ্ডল মণ্ডল’ বলে তিরস্কার করত কে বা কারা, এখন তা আরও বেড়ে গেছে।”
গণিতের শিক্ষক হলেও হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল গণিত ও বিজ্ঞান দুটো বিষয়ই শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। কোভিড মহামারীর আগে আগে প্রতিদিন তিনটি ব্যাচে শিক্ষার্থীরা তার কাছে পড়তে যেত।
সেই ক্লাসের দুদিন পর স্কুলে বিক্ষোভের প্রসঙ্গ ধরে ববিতা বলেন, “শিক্ষার্থীদের পক্ষে একা ঘটানো সম্ভব না। স্কুলের ভেতরের বা বাইরের কেউ না কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। পূর্বপরিকল্পিত না হলে বহিরাগতরা স্কুলের মধ্যে ঢুকবে কীভাবে?”
হৃদয় মণ্ডলের অন্যতম আইনজীবী মুন্সীগঞ্জ জেলা হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সভাপতি অজয় চক্রবর্তী বলেন, “এই যে ঘটনাটি শিক্ষকরাও ছাত্রদের দিয়ে করিয়ে থাকতে পারে, অনেক সময় প্রাইভেট টিউশনি নিয়েও তাদের মধ্যে মনোমালিন্য থাকে। একজন ভালো শিক্ষক তাকে যদি সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সেখানে এসে আরেকজন সেই সুবিধাটুকু নেবে।
“কিসের কারণে এই ঘটনা, যিনি এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, তিনি বিষয়টি দেখবেন এবং সঠিক কারণটি খুঁজে বের করবেন এটাই কাম্য।”