গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। দুই মাস হতে চলেছে। এ লড়াইয়ে নেটোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল- রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে কীভাবে মিত্র ইউক্রেইনকে যথেষ্ট সামরিক সহায়তা দেওয়া যায় সেটি।
ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বার বার নেটোর কাছে সাহায্যের আবেদন করে গেছেন।
আগ্রাসনের শুরুতে রুশ বাহিনী ইউক্রেইনের রাজধানী কিইভ দখল করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখন তাদের মনোযোগ সরে গেছে এবং তারা এখন পূর্ব ইউক্রেইনের দনবাস অঞ্চল দখলের দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছে।
দনবাস অঞ্চলের অনেকাংশই ২০১৪ সাল থেকে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে। যেটুকু ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে এখন সেটুকু দখল করতে চায় রাশিয়া। দনবাস অঞ্চলের নেতারা এরই মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন।
কিন্তু আবারও নিজেদের ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে চাইবে না ইউক্রেইন সরকার। তাই তারা চরম যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এজন্য তাদের আরও অস্ত্র চাই। পাশ্চিমা বিশ্ব এরইমধ্যে ইউক্রেইনকে প্রচুর আধুনিক সমরাস্ত্র দিয়েছে, ভবিষ্যতে আরও দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও আছে। কিন্তু ইউক্রেইনের আরও চাই।
পশ্চিমারা এখন পর্যন্ত জ্যাভলিন, এনএলএডব্লিউ (পরবর্তী প্রজন্মের হালকা অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্র), স্টিংগার, স্টারস্ট্রিক অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক এবং বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। যে অস্ত্রগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু ইউক্রেইন এখন রাশিয়ার বাড়তে থাকা বিমান হামলা এবং দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা (ইউক্রেইনের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানির ভাণ্ডার এবং অন্যান্য ব্যবস্থায় ওই হামলা হচ্ছে) রুখতে ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং পরবর্তী প্রজন্মের আকাশ সুরক্ষা ব্যবস্থা চাইছে।
তহলে ঠিক কী কারণে নেটো এখনও যুদ্ধের ময়দানে নামছে না? এমন প্রশ্ন করতে পারেন অনেকেই। এর উত্তর হল, তাতে যুদ্ধ আরও বাড়বে।
সেক্ষেত্রে রাশিয়ার কৌশলগত (স্বল্প পাল্লার) পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি যেমন বাড়বে, তেমনি যুদ্ধ ইউক্রেইনের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর ইউরোপীয় যুদ্ধে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। এটা পশ্চিমা নেতাদের মনে বার বার শঙ্কা জাগাচ্ছে এবং এখানে বিপদের ঝুঁকি খুবই বেশি।
ছবি: বিবিসি ভিডিও
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেইন যুদ্ধের শুরুতেই বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, রাশিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং সেগুলোকে তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুতের পথে যায়নি। কারণ, রাশিয়ার নিরাপদ ভান্ডারগুলো থেকে কোনও পারমাণবিক অস্ত্রের নড়াচড়া দেখতে পায়নি তারা। কিন্তু পুতিন হুমকি ঠিকই দিয়ে রেখেছেন, যাতে কেউ রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চেষ্টা না করে।
রাশিয়ার সামরিক মতবাদে যুদ্ধক্ষেত্রে কম বিধ্বংসী, কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেড আগাম ব্যবহারের এখতিয়ার আছে। আর পশ্চিমারা যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার পরিহার করেছে সেটাও জানা। প্রায় ৭৭ বছর এ অস্ত্র ব্যবহার হয়নি।
নেটো কৌশলের পরিকল্পনাবিদরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে এই সংযম ভেঙে পড়লে, তাতে যদি ইউক্রেইনের যুদ্ধক্ষেত্রে স্থানীয় কোনও নিশানায় সীমিত আকারের ক্ষয়ক্ষতিও হয়, তাহলেও রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের পাল্টাপাল্টি হামলার বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টির ঝুঁকি নিশ্চিতভাবেই বাড়বে।
তাছাড়া, ইউক্রেইনে রাশিয়া আরও নৃশংস কর্মকাণ্ড ঘটাতে থাকলে নেটোর অবস্থান আরও কঠিন হবে এবং এই জোটের সংযমও ভেঙে পড়তে থাকবে।
চেক রিপাবলিক এরই মধ্যে ট্যাংক পাঠিয়েছে ইউক্রেইনে, এগুলো পুরোনো সোভিয়েত মডেলের হলেও ইউক্রেইনকে এই প্রথম সহায়তা করেছে চেক রিপাবলিক। আরেক দেশ স্লোভাকিয়াও ইউক্রেইনকে প্রথম সোভিয়েত আমলের এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সাহায্য করেছে। ইউক্রেইনকে বিভিন্ন দেশের এমন সহায়তার হাত বাড়ানোর পদক্ষেপ ওইরকম যুদ্ধের ক্ষেত্রে অভাবনীয়রকম ঝুঁকিপূর্র্ণ হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ডিফেন্স কমিটির চেয়ারম্যান এমপি তোবাইস এলউড অন্য অনেকের মতোই বিশ্বাস করেন যে, পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত রাখার কথা বলে ভয় দেখাচ্ছেন এবং এক্ষেত্রে নেটোর আরও বেশিকিছু করার আছে।
তিনি বলেন, “আমরা (ইউক্রেইনকে) যে অস্ত্র ব্যবস্থা দিতে চেয়েছি তা দেওয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক থেকেছি। আমাদের আরও বেশি বলিষ্ঠ মনোভাব থাকা প্রয়োজন। আমরা ইউক্রেইনকে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট দিচ্ছি, কিন্তু জয় পাওয়ার জন্য দিচ্ছি না। এই মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে।”
ছবি: বিবিসি ভিডিও
তাহলে ঠিক কিভাবে এই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ আরও বেড়ে গিয়ে বড় ধরনের প্যান-ইউরোপীয় সংঘাতে মোড় নিতে পারে এবং নেটো এতে জড়িয়ে পড়তে পারে? সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য তিনটি পরিস্থিতি এক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে বিবিসি:
১. ইউক্রেইনের সেনাবাহিনী নেটোর সরবরাহ করা একটি জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ওডেসার কাছে কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার একটি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিলে এতে যদি প্রায় ১০০ নাবিক এবং কয়েক ডজন নৌ-সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে; তাহলে মাত্র একটি আঘাতে এই পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে নজিরবিহীন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তখন কোনও না কোনওভাবে জবাব দেওয়ার জন্য চাপের মধ্যে থাকবেন।
২. দ্বিতীয়ত: যদি পোল্যান্ড অথবা স্লোভাকিয়ার মতো নেটো সদস্যদেশ থেকে অস্ত্র ও সমর সরঞ্জামের কোনও বহর ইউক্রেইনে ঢোকার সময় সেটি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয় এবং নেটো অংশের সীমান্তে হতাহতের ঘটনা ঘটে, তবে নেটোর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ কার্যকর হয়ে উঠবে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নেটোভুক্ত কোনও দেশ আক্রান্ত হলে পুরো জোট তা প্রতিহত করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
৩. তৃতীয়ত: দনবাসে প্রচণ্ড লড়াইয়ের মধ্যে যদি কোনও রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণে ঘটে এবং সেখান থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস নির্গত হয়, যদিও ইতিমধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তবে কারও মারা যাওয়ার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু যদি এমন বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ার ঘটনায় ব্যাপক মানুষ হতাহত হত, যেমনটি সিরিয়ার গৌতায় হয়েছে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ার এক ঘটনায়, তেমনটি যদি ঘটে এবং প্রমাণিত হয় যে, রুশ বাহিনী এটা ইচ্ছা করে ঘটিয়েছে, তবে নেটো এর জবাব দিতে বাধ্য হবে।
এই তিন সম্ভাব্য পরিস্থিতির কোনোটিই বাস্তব রূপ না নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে রাশিয়াকে প্রতিহত করতে পশ্চিমা দেশগুলো যে ঐক্য দেখাচ্ছে সেটিও বিরল। তারপরও কথা আছে। আর তা হচ্ছে, তারা নিছকই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যাচ্ছে, শেষ খেলাটা কী হবে তা নিয়ে ভাবছে না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন শীর্ষ অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমাদের সরকার কী প্রকৃত কৌশল নিয়ে ভাবছে নাকি সংকট ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত, এটিই এখন বড় কৌশলগত প্রশ্ন।
“আমরা এখন যেটা করার চেষ্টা করছি তা হল, ইউক্রেইনকে আমাদের যথাসাধ্য সহায়তা করা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া আটকানো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পুতনি আমাদের চাইতে ভালো পোকার খেলোয়াড়।”
তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ব্রিটিশ এমপি তোবাইস এলউডও বলেন, রাশিয়া খুব ভালভাবেই হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আর নেটো ভয়ে সিটকে আছে। পরিস্থিতিকে বাগে আনার সক্ষমতাই এই জোট হারিয়ে ফেলেছে।