ক্যাটাগরি

শতবর্ষে ‘সলপের ঘোল’, রোজায় বাড়ে চাহিদা

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ঐতিহ্যবাহী ‘সলপের ঘোল’ অন্য সময়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মণ বিক্রি হলেও রোজায় তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

সিরাজগঞ্জ ছাড়াও এই ঘোলের স্বাদ নিচ্ছেন দেশের নানা জায়গার মানুষ। এই পানীয় বিক্রি করে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন।  

উল্লাপাড়ার সলপ রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে এই ব্যবসা গড়ে উঠেছে বলে এটি ‘সলপের ঘোল’ নামে পরিচিত। এর পেছনের ইতিহাস শতবর্ষের। ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম শুক্রবার এখানে আয়োজন করা হয় ‘ঘোল উৎসব’। 

এই ব্যবসায়র সঙ্গে সিরাজগঞ্জসহ দেশে বহু জেলার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে গেছে

এই ব্যবসায়র সঙ্গে সিরাজগঞ্জসহ দেশে বহু জেলার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে গেছে

‘সলপ ঘোল ঘর অ্যান্ড সাদেক খান দই ঘর’-এর স্বত্বাধিকারী আব্দুল মালেক খান জানান, তাদের এই ব্যবসার সঙ্গে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে গেছে। এখান থেকে কাজ শিখে কারিগররা উপজেলাতেই নিজেরাও দোকান দিয়েছেন।

স্বাদ ও মান অনুযায়ী এই ঘোলের দাম তুলনামূলক সস্তা বলে মনে করেন ক্রেতারা। তাই সুস্বাদু এই পানীয় কিনতে তারা এখানেই আসেন। 

শতবর্ষী এই ব্যবসার শুরু ১৯২০ সালে। ব্রিটিশ শাসনামলে উল্লাপাড়ার সলপ এলাকায় রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এর দুই বছর বাদে ১৯২২ সালে এই স্টেশনের কাছেই ঘোল ও দধির ব্যবসা শুরু করেন স্থানীয় সাদেক আলী খান। তার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেছেন দুই ছেলে আব্দুল খালেক খান ও আব্দুল মালেক খান।   

আশেপাশের গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা দুধ নির্দিষ্ট সময় ধরে জ্বাল দেওয়া হয়

আশেপাশের গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা দুধ নির্দিষ্ট সময় ধরে জ্বাল দেওয়া হয়

যে প্রক্রিয়ায় ঘোল তৈরি হয়

প্রতিদিন ভোরে আশপাশের গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দেওয়ার পর সেটি সারারাত পাত্রে রাখা হয়। সকালে জমে থাকা ওই দুধের সঙ্গে চিনি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় ঘোল।

সারাত ধরে জমানো দুধের সঙ্গে চিনি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় ঘোল

সারাত ধরে জমানো দুধের সঙ্গে চিনি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় ঘোল

দাম ও বিক্রি

বর্তমানে প্রতি লিটার ঘোল ৬০ টাকা এবং মাঠা ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বছরের অন্য সময়ে প্রতিদিনের বিক্রিবাট্টা ১৫ থেকে ২০ মণ। কিন্তু রোজার বিক্রি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সিরাজগঞ্জের বাইরে পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে এই ঘোল।  

‘সলপ ঘোল ঘর অ্যান্ড সাদেক খান দই ঘর’-এর স্বত্বাধিকারী আব্দুল মালেক খান বলেন, “ঘোলের জন্য অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে এই এলাকায় আসেন। এখান থেকে ঘোল পাইকারি দরে কিনে নিয়ে ব্যবসা করে অনেকেই সমৃদ্ধ হচ্ছেন।

“এখানে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। সরকারিভাবে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে আমরা উপকৃত হব। এতে আমাদের শতবর্ষের মিষ্টান্ন শিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটানো সম্ভব।”

বর্তমানে প্রতি লিটার সলপের ঘোল ৬০ টাকায় এবং মাঠা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়

বর্তমানে প্রতি লিটার সলপের ঘোল ৬০ টাকায় এবং মাঠা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়

চলতি বছর তাদের এই ব্যবসা ১০০ বছর পূর্ণ করেছে, যা তাদের কাছে আনন্দের এবং গর্বের বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি আজমত আলী ও আব্দুল জব্বার জানান, এক সময়ে সলপের তৈরি ঘোল ভারতের কলকাতার মানুষের কাছেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। ট্রেনে করে প্রতিদিন ঘোল নিয়ে যাওয়া হতো কলকাতায়।

সিরাজগঞ্জ শহর থেকে সলপের ঘোল কিনতে আসা শরিফুল ইসলাম ও মকবুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সলপের ঘোলের স্বাদ অতুলনীয়। প্রায়ই আমরা বন্ধুরা সুস্বাদু এই ঘোল কিনতে আসি।”

ঘোলের মান অনুযায়ী দাম তুলনামূলক সস্তা জানিয়ে ক্রেতারা বলেন, রোজায় চাহিদা বেশি থাকায় সকাল সকাল তারা চলে এসেছেন।

১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম শুক্রবার সলপে 'ঘোল উৎসব' হয়ে আসছে

১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম শুক্রবার সলপে ‘ঘোল উৎসব’ হয়ে আসছে

গাজীপুরের তরুণ উদ্যোক্তা ইমরান হোসেন সিরাজগঞ্জ থেকে তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, থ্রি পিসের পাশাপাশি মিষ্টি, দই ও সলপের ঘোলও বিক্রি করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গাজীপুরে সারা বছরই সলপের ঐতিহ্যবাহী ঘোলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। অল্প দামে ভালো মানের ঘোল ও মাঠা পেয়ে গ্রাহকরাও খুশি। বিশেষ করে রমজানে চাহিদা আরও বেড়েছে।”

অনেক গ্রাহক আগাম অর্ডারও করছেন; তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘোল সংরক্ষণ করতে না পারায় অনেক সময় ক্রেতার চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়ে ওঠে না বলেও জানান ইমরান।

১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম শুক্রবার সলপে 'ঘোল উৎসব' হয়ে আসছে

১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম শুক্রবার সলপে ‘ঘোল উৎসব’ হয়ে আসছে

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রহমত আলী রোজার শুরু থেকে সিরাজগঞ্জ শহরে ভ্যানগাড়িতে ফেরি করে সলপের ঘোল বিক্রি করছেন।

শহরে সলপের ঘোলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে জানিয়ে রহমত আলী বলেন, “প্রতিদিন সকালে এনে দিনভর বিক্রি করি। ৬০ টাকায় কিনে প্রতি লিটার বিক্রি করি ৮০ টাকা। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ মণ ঘোল বিক্রি করা যায়।”  

১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম শুক্রবার সলপে ‘ঘোল উৎসব’ হয়ে আসছে। ১৯৯৮ থেকে সিরাজগঞ্জ শহরের ‘প্রভাতী সংঘ’ উৎসবের আয়োজন করছে, তবে এর মূল উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ সরকার।