কিন্তু ঘাতকেরা চাইল প্রথাবিরোধী এই লেখককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে; ছুরি-চাপাতি নিয়ে হামলে পড়ল তার উপর।
চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হলেও সেই আঘাতের পর তার জীবন প্রদীপ জ্বলেছিল মাত্র ছয় মাস।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলার নির্ধারিত সময় যখন শেষ হচ্ছে, তখন পায়ে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে ফেরার পথে আক্রান্ত হন হুমায়ুন আজাদ।
আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের অভিযোগপত্র আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় একটি ধারণা পাওয়া যায়, কী ঘটেছিল সেই রাতে।
সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন, ঘটনার দিন জেএমবি নেতা আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে মিজানুর রহমান মিনহাজ একটি চাপাতি নিয়ে, জেএমবির ‘কিলিং স্কোয়াডের সদস্য’ নূর মোহাম্মদ ওরফে শামিম কাঠের বাটওয়ালা সামনের দিকে তিনটি ছিদ্রযুক্ত ছুরি নিয়ে, ভাগ্নে শহিদ ও নুরুল্লাহ হাফেজ বোমা নিয়ে রাত ৮টার দিকে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে অবস্থান নেয়।
এরপর রাত সোয়া ৯টার দিকে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বই মেলা বের হয়ে পায়ে হেঁটে পূর্বপাশের ফুটপাত দিয়ে টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় আক্রান্ত হন।

হুমায়ুন আজাদ। ছেলে অনন্য আজাদের ফেইসবুক থেকে
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, বাংলা একাডেমি ও টিএসসির মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছালে আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে ঘেরাও করে ফেলা হয়।
“মিজানুর রহমান মিনহাজ ও শামিম ব্যাগ থেকে চাপাতি ও ছুরি বের করে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ঘাড়ে, মাথায়, মুখে, গলায়, হাতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত ও মারাত্মক জখম করে ঘটনাস্থলে চাপাতি ও ছুরি ফেলে দেওয়ার সাথে সাথে ভাগ্নে শহিদ ও হাফেজ নুরুল্লাহ তাদের ব্যাগে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অন্ধকারে জনগণের সাথে মিশে যায়।”
দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর রাত ১১টার দিকে পৃথক পৃথকভাবে ঘাতকরা মাদারটেকের একটি বাসায় পৌঁছায়। এরপর তারা জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমানকে মোবাইল ফোনে ঘটনা জানায় বলে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে লিখেছেন।
ওই ঘটনায় শায়খ রহমান ও সানি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। অন্য মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় তাদের বিচারের সুযোগ হয়নি।
হামলার ঘটনার পর রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শরিফুল হাসান। এ মামলায় তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্যও দিয়েছেন।
সেদিনের কথা স্মরণ করে শরিফুল বলেন, “আমি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গান শুনছিলাম।… হঠাৎ একটি বোমা বিস্ফোরণের মত শব্দ হল। নিজেকে খুব সাহসী বলব না, তবে ভয়টা একটু কম!
“তো কোথা থেকে এল সেই শব্দ, সেটি জানতে টিএসসি থেকে দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম বাংলা একাডেমির দিকে। আজো মনে আছে, রাস্তার মাঝে যে সড়ক বিভাজন ছিল, সেটি ধরে হাঁটছিলাম। এক জায়গায় কয়েকজন লোকের ভিড় দেখে গেলাম। আগেই বলেছি, রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে অছে রক্তাত্ব একজন মানুষ। কিন্তু কেউ ধরছে না।”
হাসান জানান, আগে সামনাসামনি না দেখলেও বইয়ের ফ্ল্যাপে কিংবা পত্রিকায় ছবি দেখে হুমায়ুন আজাদের চেহারা তার বেশ পরিচিতই ছিল।
“কাছে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন একজন মানুষ। পুরো মুখমণ্ডল রক্তাত্ত্ব। আমি ধরে মুখটা ঘোরাতেই চিনতে পারি। এরপর চিৎকার করে বলি, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার হুমায়ুন আজাদ। এখনি হাসপাতালে নিতে হবে! কিন্তু কীভাবে নেব?”
হুমায়ুন আজাদ হত্যা: ৪ জঙ্গির ফাঁসির রায়
১৮ বছর পর রায় দিয়ে কী হবে, হতাশা হুমায়ুন আজাদের পরিবারের
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের তখনকার সংগঠক, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব আশরাফ সিদ্দিকী বিটুর সাথে যোগাযোগ করার কথা জানান হাসান।
হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিতে পাশ দিয়ে যাওয়া একটি প্রাইভেট কারকে অনুরোধ করলেও চালক রাজি হননি। অগত্যা রক্তাক্ত লেখককে কাছাকাছি থাকা পুলিশ ট্রাকের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেই ট্রাকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় হুমায়ুন আজাদকে। ট্রাকে তোলার ওই সময়ে রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদের ছবি তোলেন একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক।
হাসপাতালে নেওয়ার সময় পুলিশের ট্রাকে হুমায়ুন আজাদের সাথে কথোপকথনের কথা তুলে ধরে শরিফুল হাসান বলেন, “স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছি। এত কাছের ঢাকা মেডিকেল মনে হচ্ছে বহুদূর।
“স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা আমাকে কই নিয়ে যাও?’ আমি বললাম, স্যার, হাসপাতালে। আপনার কিছু হয়নি। আপনি ভালো হয়ে যাবেন। স্যার বললেন, ‘আমার চশমা কই?’ আমি বললাম, স্যার, আছে। স্যার বললেন, ‘আমাকে তুমি পুলিশের গাড়িতে কেন নিয়েছ?’ আমি বললাম, স্যার, আমরা আপনার ছাত্র। ঠিক আছে স্যার আমরা এখুনি নেমে যাব।”
ওই রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গুরুতর আহত হুমায়ুন আজাদকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
দ্রুত সময়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিতে পেরে যে স্বস্তি শরিফুল হাসান সেদিন পেয়েছিলেন, ছয় মাসের মাথায় তা উবে যায় লেখকের মৃত্যুর খবরে।
“আমরা পরে জেনেছিলাম, স্যারকে কুপিয়ে ফেলে যাওয়ার ১০-১২ মিনিটের মাথায় আমরা হাসপাতালে নিতে পেরেছিলাম। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, আরেকটু দেরি হলে রক্তক্ষরণে স্যার মারা যেতে পারতেন! ভেবে খুব ভালো লাগছিল, যে স্যারকে আমরা বাঁচাতে পেরেছিলাম। কিন্তু আসলে কী বাঁচাতে পেরেছিলাম? ছয় মাস পর তো স্যার মারা গেলেন জার্মানিতে!”

হুমায়ুন আজাদ। ছবি: হাসান বিপুল
হুমায়ুন আজাদকে ধরাধরি করে পুলিশ ট্রাকের দিকে নেওয়ার সময় চিৎকার করা অবস্থায় শরিফুল হাসানের একটি ছবি প্রকাশ হয় পত্রিকায়। পোস্টারে পোস্টারে ওই ছবি ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।
ছবিতে চিৎকারের ভঙ্গিকে অনেকে ‘হাসি’ হিসাবে ধরে নেওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল বলে জানান হাসান। তদন্ত চলার মধ্যে তাকে ও বিটুকে মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়েও ডেকে নেওয়া হয়েছিল।
ফিল্যান্স সাংবাদিক হাসান বলেন, “সিআইডি কার্যালয়ে এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ওই ঘটনার পরদিন যখন ছবিটা পত্রিকায় ছাপা হল, তখন তাদের ওপর খুব চাপ ছিল, যে ছেলেটা রক্তাক্ত স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছে, তাকে যেন অ্যারেস্ট করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তারা সেটা করেননি।
“উনি বলেছিলেন, ‘আমরা জেনেছি, পুলিশের ট্রাকে আপনারা স্যারকে হাসপাতালে নিয়েছেন। কাজেই আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি’।”
২৭ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়ার জন্যে পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা খান আসাদুজ্জামান মাসুম। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
মাসুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশে লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, মুক্তমনা মানুষের উপর যে ধারাবাহিক হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার সূচনা হয়েছিল হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে।
“স্যারকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিরা যে হুমকি দিয়ে আসছিল, তৎকালীন সরকার তা জানত। কিন্তু এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে খুবই উদাসীন ছিল তারা।”
হামলার পর সিএমএইচ ও থাইল্যান্ডে কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০০৪ সালের অগাস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান হুমায়ুন আজাদ। ওই বছর ১২ অগাস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
মৃত্যু সনদের বরাতে অভিযোগপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসের আঘাতে জেরে লেখকের মৃত্যু হয়েছে। অ্যানাটমিক্যালি আকস্মিক মৃত্যুর কোনো প্রমাণ পাওয়া মেলেনি।
আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, “আক্রান্ত হইয়া মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি অসুস্থ ও আতংকগ্রস্ত হইয়া পড়েন। চিকিৎসার পরও আরোগ্য না হইয়া বরং তিনি ধীরে ধীরে আরও বেশি অসুস্থ হইয়া জার্মানি মিউনিখে নিজ বাসস্থানে যাওয়ার চারদিন পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়েন।”
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় হুমায়ুন আজাদের উপর ওই হামলার ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা।
কয়েক সপ্তাহ আন্দোলনের এক পর্যায়ে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও পুলিশ, আহত হন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
চরমপন্থি ইসলামী জঙ্গিরা হুমায়ুন আজাদের ওপর ওই হামলা চালিয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল পাঁচ জঙ্গির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তাদের মধ্যে একজন পালাতে গিয়ে কথিত বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হন।
দেড় যুগ পর বুধবার আলোচিত এই মামলার রায়ে ৪ জেএমবি জঙ্গির ফাঁসির রায় দেয় ঢাকার একটি আদালত। পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডও দেওয়া হয় তাদের।
তাদের মধ্যে দুই আসামি মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন এবং আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাকি দুই আসমি নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু এবং সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ পলাতক।