ক্যাটাগরি

মহাকাব্যিক লড়াইয়ে চেলসিকে পেছনে ফেলে সেমিতে রিয়াল

সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে মঙ্গলবার রাতে কোয়ার্টার-ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ৩-২ গোলে হেরে গেছে রিয়াল। তবে প্রথম লেগের ৩-১ ব্যবধানে জয়ের সুবাদে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৪ গোলের অগ্রগামিতায় শেষ চারে উঠেছে কার্লো আনচেলত্তির দল।

রিয়ালকে তাদেরই মাঠে ফ্যাকাসে করে তুলতে যা যা দরকার ছিল, ৯০ মিনিটে ঠিক তাই তাই-ই করে দেখাল চেলসি। রক্ষণরেখাকে ওপরে তুলে এনে একইসঙ্গে দারুণ সব আক্রমণের পাশাপাশি ঘরও রাখে আগলে।

ম্যাসন মাউন্টের গোলে আত্মবিশ্বাসী শুরুর পর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে গতবারের চ্যাম্পিয়নরা। পুরো মাঠেই প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখে তারা। দ্বিতীয়ার্ধেও একইভাবে শুরু করে আন্টোনিও রুডিগারের লক্ষ্যভেদের পর টিমো ভেরনারের দারুণ গোলে চালকের আসনে বসে যায় তারা।

ম্যাচ তো বটেই, পুরো লড়াইটাই তখন যেন চেলসিময়। এরপরই রদ্রিগোর গোল। বদলে যায় দৃশ্যপটে। ঘুরে যায় ম্যাচের মোড়। চেলসির আক্রমণের ধার অবশ্য কমেনি; তবে জালের দেখা আর পায়নি তারা। নির্ধারিত সময়ের বিবর্ণ করিম বেনজেমা অতিরিক্ত সময়ে গড়ে দেন ব্যবধান।    

ফিকে হয়ে যাওয়া আশা পুনরুজ্জীবিত করতে, লড়াইয়ে ফিরতে যেকোনো মূল্যে গোল চাই- ম্যাচের শুরু থেকে চেলসির খেলায় ফুটে ওঠে এই মরিয়া ভাব। রিয়ালের কারো পায়ে বল গেলেই তাকে ঘিরে ধরছিল দুই-তিন জন। তাতে প্রথম কয়েক মিনিটে তো নিজেদের অর্ধ থেকে বের হতেই পারছিল না স্বাগতিকরা।

যে আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে চেলসির মধ্যে, তার বলেই পঞ্চদশ মিনিটে গোল আদায় করে নেয় তারা। দারুণ পাসিং ফুটবলে গড়া আক্রমণে রুবেন লোফ্টাস-চিকের ফ্লিকে হাঁটুর টোকায় ভেরনার বল বাড়ান ডি-বক্সে আর ছুটে গিয়ে প্রথম ছোঁয়ায় জোরাল শটে গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন মাউন্ট।

পরের মিনিটেই পাল্টা গোলের সুযোগ পায় রিয়াল। মাঝমাঠের কাছ থেকে বেনজেমার থ্রু বল ফাঁকায় পেয়ে দ্রুত এগিয়েও কী ভেবে গতি কমিয়ে দেন ভিনিসিউস জুনিয়র। এরপর বাঁ দিক থেকে বক্সে ডান দিকে বাড়ান বল, যেখানে তার কোনো সতীর্থই ছিল না। পেছনে হতাশা প্রকাশ করেন বেনজেমা।

৩৪তম মিনিটে অনেক দূর থেকে জোরাল শটে আরেক দফা ভীতি ছড়ান রুডিগার। বল পোস্টের বাইরে দিয়ে গেলে হাফ ছাড়ে রিয়াল।

প্রথমার্ধের লড়াই কতটা একপেশে ছিল, তা ম্যাচ পরিসংখ্যানে ফুটে ওঠে। গোলের উদ্দেশ্যে চেলসি সাত শট নিয়ে দুটি রাখে লক্ষ্যে, সেখানে রিয়াল তিনটি শট নিলেও, একটিও সেভাবে ভাবাতে পারেনি প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে।

বিরতির পরও রিয়াল সেই আগের মতোই বিবর্ণ, নিষ্প্রাণ ফুটবল খেলতে থাকে। বলা যায়, তাদেরকে জ্বলে ওঠার জায়গাই দেয়নি চেলসি। পুরো মাঠের সবখানেই যেন ছিল চেলসির খেলোয়াড়দের কড়া পাহারা।

৫১তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করার পাশাপাশি দুই লেগ মিলিয়ে স্কোরলাইনে সমতা টানে শিরোপাধারীরা। গোল হতে পারত আগের মিনিটেই, তবে রিস জেমসের বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া শট পোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। বল মদ্রিচের পায়ে লেগে গিয়েছিল ভেবে কর্নার দেন রেফারি, যদিও রিপ্লেতে দেখা যায়, ক্রোয়াট মিডফিল্ডারের পায়ে বল স্পর্শ করেনি। ওই কর্নারেই দারুণ হেডে রিয়ালকে আরও কোণঠাসা করে ফেলেন রুডিগার।

পরের ছয় মিনিটে দুটি ভালো সুযোগ পায় রিয়াল। প্রথমবার বেনজেমা ছয় গজ বক্সে বলে পা লাগাতেই পারেননি। আর দ্বিতীয়বার টনি ক্রুসের দারুণ ফ্রি কিক অসাধারণ নৈপুণ্যে ঝাঁপিয়ে ফেরান এদুয়াঁ মঁদি।

৬২তম মিনিটে ডিফেন্ডার ফেরলঁদ মঁদির ভুলে বল পেয়ে আক্রমণে ওঠে চেলসি। মার্কোস আলোনসো জালে বলও পাঠান; কিন্তু আগমুহূর্তে বল তার আঙুল ছোঁয়ায় ভিএআরে পাল্টায় সিদ্ধান্ত। বেঁচে যায় রিয়াল।

আগের দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করা বেনজেমা ৬৬তম মিনিটে গোল পেতে পারতেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি, তার হেডে বল ক্রসবারে বাধা পায়।

শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ে ৭৫তম মিনিটে একক নৈপুণ্যে বের্নাবেউকে স্তব্ধ করে দেন ভেরনার। বক্সে বল পায়ে ঢুকে প্রথমে দানি কারভাহালকে কাটিয়ে দাভিদ আলাবার বাধা এড়িয়ে শট নেন জার্মান ফরোয়ার্ড। বল গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার গায়ে লেগে খুঁজে নেয় ঠিকানা।

ম্যাচের স্কোরলাইন ৩-০, দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৩ গোলে এগিয়ে চেলসি।  সেমি-ফাইনাল তখন তাদের দৃষ্টিসীমানায়।

৭৮তম মিনিটে আক্রমণের ধার বাড়াতে কাসেমিরোকে তুলে রদ্রিগোকে নামান আনচেলত্তি। সিদ্ধান্তটা কতটা সঠিক ছিল, তার প্রমাণ মিলে যায় দুই মিনিট পরই। মদ্রিচের অসাধারণ এক ক্রসে দারুণ ভলিতে বল জালে জড়ান ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। জেগে ওঠে রিয়াল, জেগে ওঠে বের্নাবেউ।

অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লেখার সম্ভাবনা ধাক্কা খেলেও চেলসির আক্রমণ থামেনি। নির্ধারিত সময় শেষে যোগ করা চার মিনিটে দুটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি ক্রিস্টিয়ান পুলিসিক। প্রথমবার গোলমুখে ফাঁকায় বল পেয়ে উড়িয়ে মারার পর দ্বিতীয়বারও ক্রসবারের ওপর দিয়ে বল পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের মিডফিল্ডার।

অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরু হতেই যেন সবকিছু নতুন রূপে ধরা দেয়। মৌসুমে রিয়ালের সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারিগর বেনজেমা-ভিনিসিউস জ্বলে ওঠেন। জ্বলে ওঠে রিয়াল। বাঁ দিকের বাইলাইন থেকে ব্রাজিলিয়ান সতীর্থের ক্রস ফাঁকায় পেয়ে অনায়াসে হেডে লক্ষ্যভেদ করেন ফরাসি স্ট্রাইকার।

আসরে বেনজেমার গোল হলো ১২টি। তার চেয়ে একটি গোল বেশি করে তালিকার শীর্ষে বায়ার্ন মিউনিখের রবের্ত লেভানদোভস্কি।

প্রথম ৯০ মিনিটে চেলসির রক্ষণ ছিল একটা দুর্গের মতো, সেই তারাই কিনা এখানে খেই হারিয়ে বসল। বক্সে বেনজেমার পাহারায় ছিলেন না কেউ!

তবে, এদিনের চেলসি তো শেষের আগে শেষ হওয়ার নয়। শেষ ১০ মিনিটে আবারও পুরনো রূপে ফেরে তারা। করতে থাকে একের পর এক আক্রমণ।

১১৪তম মিনিটে আবারও ভীতি ছড়ায় তারা। হাকিম জিয়াশ নেন জোরাল শট, তবে বিশ্বস্ত দেয়াল হয়ে ছিলেন কোর্তোয়া। বাকি সময়ে আরও দুটি ভালো সুযোগ আসে তাদের সামনে। কিন্তু আর কেউ দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিতে পারেননি। কাই হাভার্টজের লক্ষ্যভ্রষ্ট হেডের পর আরেকবার হতাশ করেন জিয়াশ।

তিন মিনিট যোগ করা সময়ে কোনোমতে রক্ষণ আগলে রেখে শেষের বাঁশি বাজতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে বেনজেমা-মদ্রিচ-ভিনিসিউসরা। বের্নাবেউয়ের তখন সে কী গর্জন!

প্রথমার্ধের মতো পুরো ১২০ মিনিটের লড়াইয়ের পরিসংখ্যানেও চেলসির দাপট স্পষ্ট। বল দখলে আধিপত্য ধরে রেখে তারা গোলের উদ্দেশ্যে শট নেয় ২৮টি, যার মধ্যে সাতটি থাকে লক্ষ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একরাশ হতাশাই সঙ্গী তাদের।

গতবার চেলসির কাছে হেরেই রিয়ালকে বিদায় নিতে হয়েছিল সেমি-ফাইনাল থেকে। এবার তাদের হারিয়েই পা রাখল শেষ চারে। তাই ঘরের মাঠে ম্যাচ জুড়ে কেবল ১০ শটের চারটি লক্ষ্যে রাখার মলিনতা, হারের হতাশা থাকলেও দুই লেগের লড়াইয়ে পাওয়া জয়ে রিয়ালের প্রতিশোধের জ্বালা হয়তো অনেকটাই মিটল।

শেষ চারে ম্যানচেস্টার সিটি অথবা আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলবে রেকর্ড ১৩ বারের চ্যাম্পিয়নরা।