ক্যাটাগরি

বিক্ষোভে আর স্লোগানে শ্রীলঙ্কায় নববর্ষ উদযাপন

বৃহস্পতিবার ভোরে আন্দোলনস্থলে কাঠের টুকরো দিয়ে আগুন জ্বেলে তাতে ছোট্ট একটি পাত্রে দুধ গরম করে নববর্ষ পালনের আনুষ্ঠানিকতার সূচনা করেন ডিলানি জয়ারত্নে।

চরম আর্থিক সংকটে দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা হয়েছে ভারত মহাসাগরের ছোট্ট এ দ্বীপরাষ্ট্রটির। দিনের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না, নেই ওষুধ, নেই জ্বালানি তেল, নিত্যপণ্যের সংকটে সেগুলো দাম আকাশ ছুঁয়েছে।

তারমধ্যেই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে এসেছে নতুন বছর। দেশটির সিংহল এবং তামিল জনগোষ্ঠী সাধারণত নিজ নিজ বাড়িতে প্রাচীন রীতি মেনে নববর্ষ পালন করেন।

কিন্তু এবছর জয়ারত্নে এবং তার পরিবার কলম্বোয় বিক্ষোভস্থলে একটি তাঁবুতে নববর্ষ পালন করছেন। যেখানে শত শত বিক্ষোভকারী সরকার বিরোধী আন্দোলন করছেন।

শুধু কলম্বো নয় বরং পুরো শ্রীলঙ্কা জুড়েই কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকারি অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করছেন।

তবে রাজাপাকসের কার্যালয়ের কাছেই ঘাসে পরিপূর্ণ একখণ্ড জমিতে দুই ডজনের মতো তাঁবুর ছোট কিন্তু ক্রমর্ধমান একটি শিবির দেশব্যাপী চলমান বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। যেটি ‘গোটা-গো ভিলেজ’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে।

৩৮ বছরের জয়ারত্নে বৃহস্পতিবার সূর্যোদয়ের আগে আগে স্বামী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে একঘণ্টার বেশি সময় ভ্রমণ করে কলম্বোর ওই বিক্ষোভস্থলে পৌঁছান। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা বাড়িতে বসে থাকতে পারি না।”

তিনি আশা করছেন, এই বিক্ষোভ প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে গদি ছাড়তে বাধ্য করতে পারবে।

একটি তাঁবুর বাইরে জয়ারাত্নের পেছনে আরো বহু বিক্ষোভকারী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা কাগজের প্লেটে চারকোণা আকারের ক্ষিরিভাত (নারকেলের দুধ ও চাল দিয়ে তৈরি), কলা, আচার এবং বাটার কেক বিক্ষোভকারীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

শ্রীলঙ্কায় নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটি বিক্ষোভের সমর্থনকারীরা সরবরাহ করেছেন। সেখানে ৫৬ বছরের জয়ারত্নে তেকানোন বলেন, ‘‘আমরা সাধারণত নতুন বছরের জন্য শুভ কামনা জানাই।

এবার আমরা আন্দোলনের জন্য শুভ কামনা জানাচ্ছি।”

ওদিকে, নতুন বছরে দেয়া বিবৃতিতে রাজাপাকসে বলেছেন, বর্তমান সংকট শ্রীলঙ্কার জন্য গত কয়েক বছরের মধ্যে মোকাবেলা করা সব থেকে বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের উচিত ঐক্য এবং আরো অধিক সহমতের ভিত্তিতে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা।”

শ্রীলঙ্কার বর্তমান সঙ্কটের মূল কারণ বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে যাওয়া। দেশটির এখন যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে কেবল কয়েক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা সম্ভব।

রিজার্ভ সঙ্কট ছাড়াও রকেট গতিতে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে। এর নেতিবাচক প্রভাব সব থেকে বেশি পড়েছে দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর।

এমনই একজন ৪৪ বছরের মেকানিক কে.ডিএইচ কুমারা। তিনি বলেন, এখন তিনি সংসারের খরচই বহন করতে পারছেন না। তার উপর আগের ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে।

“এই প্রেসিডেন্টকে হৃদয় থেকে সমর্থন করা ব্যক্তিদের একজন আমি। আমি রাজাপাকসেকে ভোট দিয়েছি। এমনকী তার জন্য জনসমাবেশের আয়োজনও করেছি। কিন্তু এখন আমি অত্যন্ত দুঃখিত এবং হতাশ। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে আমি শুধু পরিবারের মুখে খাবারটাই তুলে দিতে পারছি,”বলেন কুমারা।

রয়টার্স জানায়, শত শত বিক্ষোভকারী রাজাপাকসের কার্যালয়ের কাছে জড়ো হয়েছেন। তাদের কারো কারো হাতে শ্রীলঙ্কার পতাকা। কেউ কেউ হাতে লেখা পোস্টারে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ ‍দাবি করছেন। কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসা রাজাপাকসে পরিবারের শাসনের অবসান চাইছেন।

বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিচ্ছেন, আর উঁচু ব্যারিকেডের পেছনে হেলমেট পরা পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। ‍তাদের ছোট ভাই বাসিলা রাজাপাকসে এ মাসের শুরুতেও দেশটির অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এই পরিবারের আরো অনেক সদস্য সরকারের উঁচু উঁচু পদে রয়েছেন।

দুই ছেলেকে নিয়ে বিক্ষোভস্থলে আসা জয়ারত্নে সতর্কতার সঙ্গে ছোট্ট পাত্রটিতে দুধ জ্বাল দিচ্ছিলেন, যেন তা উপচে পড়ে না যায়। তিনি জানান, দুই ছেলেকে বিক্ষোভস্থলে নিয়ে আসার কারণ হচ্ছে, তারা যেন নিজের চোখে দেখতে পায় এই বিক্ষোভ কীভাবে জাতি, শ্রেণি ও ধর্মীয় বিভেদ ভুলে শ্রীলঙ্কার সব মানুষকে এক করেছে।

“আমার ছেলেদের অবশ্যই সত্যটা জানতে হবে। দেশে আসলে কী ঘটছে সেটা সম্পর্কে তাদের অবশ্যই অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তারা তাদের বাকি জীবন এই নববর্ষের কথা মনে রাখবে,”বলেন জয়ারত্নে।