ক্যাটাগরি

রঙে ফেরার মঙ্গলযাত্রায় নির্মল আগামীর প্রত্যাশা

মুখোশের মুখে বাঘ আছে, আছে হুতুম পেঁচা; ওই যে মাথা উঁচিয়ে রাজা আর রানি, পেছনেই ডাগর চোখের ঘোড়া, ডানা মেলে উড়াল দিচ্ছে মাছ। আছে লাল আর কমলা; হলুদ, সবুজ, সাদারাও।  

বৈশাখের প্রথম প্রভাতে ঢাকার রাস্তায় শোভাযাত্রা করে তারা গাইল- ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’।

রজনীকান্ত সেনের গান থেকে ওই পংক্তিকে প্রতিপাদ্য করেই বৃহস্পতিবার ১৪২৯ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ।

মহামারীর মন্দ সময় পেরিয়ে জীবনের চেনা ছন্দে ফিরছে বাংলাদেশ,দু’বছর  পর বাংলা বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা ফিরেছে বদলে যাওয়া পথে।

মহামারীর দুঃসময় পেরিয়ে দুই বছর পর বৃহস্পতিবার বৈশাখের প্রথম সকালে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের কাজ চলায় শাহবাগ থেকে টিএসসির চেনা পথ পদলে ঢোলের বাদ্যে শোভাযাত্রা এবার এগিয়েছে টিএসসি থেকে নীলক্ষেতের দিকে।

চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে সমৃদ্ধ, উন্নত, অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক বাংলাদেশের প্রত্যয় এসেছে বর্ষবরণের ঐতিহ্য হয়ে ওঠা বৈশাখী এই আয়োজনে।  

সকালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন শেষ হতে হতে চারুকলা অনুষদের শোভাযাত্রার প্রস্তুতিও সারা হয়ে যায়। সকাল ৯টা ১ মিনিটে টিএসসির সড়ক দ্বীপের সামনে থেকে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে শুরু হয় মঙ্গলের যাত্রা। ভিসি চত্বর ঘুরে আবার একই জায়গায় এসে শেষ হয়।

বৈশাখী সাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের এই শোভাযাত্রায় সামনে-পেছনে বাদ্যের তালে তালে চলে নৃত্য, হাতে হাতে ছিল বাহারি মুখোশ। পুষ্পাকৃতির চরকি, টেপা পুতুল আর পাখির শিল্পকাঠামো শোভাযাত্রাকে দেয় বাঙালির চিরায়ত আবহ।

করোনাভাইরাস মহামারীতে ২০২০ সালে বর্ষবরণের আয়োজন গুটিয়ে যাওয়ায় মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়নি। ২০২১ সালেও পরিস্থিতি পক্ষে ছিল না, মঙ্গল শোভাযাত্রা হলেও তা ছিল প্রতীকী, সেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না।

ভাইরাসের দাপট কমে আসায় এবার বিধি-নিষেধের বেড়াজাল উঠেছে, তাই ভোরের আলো ফুটতেই বৈশাখী সাজে নানা বয়সী মানুষ জড়ো হতে থাকে রমনা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। অল্প সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাস পরিণত হয় লাল-সাদা জনস্রোতে।

গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়েছে নিরাপত্তার কড়াকড়ির মধ্যে। পুলিশ, র‍্যাব, এপিবিএন ও সোয়াটের সদস্যরা অস্ত্র হাতে সামনে-পেছনে গড়ে তোলেন নিরাপত্তা বলয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসির সদস্যরাও ছিলেন তাদের সঙ্গে।

শোভাযাত্রা শুরু আগে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “একটি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের জন্য আমাদের যে দৃঢ় প্রত্যয়, সেটি আমরা ব্যক্ত করছি। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক সুদৃঢ় হোক। যে কোনো ধরনের অপশক্তি বা অশুভ শক্তি দূরীভূত হোক, সেটাও ১৪২৯ বঙ্গাব্দে আমাদের প্রত্যাশা।

“একই সঙ্গে আমাদের যে জাতীয় উন্নয়ন, সকল উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সেই উন্নয়ন কার্যক্রম আরও গতি পাক। সমৃদ্ধ, উন্নত, অসাম্প্রদায়িক মানবিক দেশ নির্মাণের জন্য চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক, জোরদার হোক, সেটি এই বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ আমাদের প্রত্যাশা।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার আয়োজনে পহেলা বৈশাখে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা নগরে বর্ষবরণের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে অনেকদিন ধরে। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করে কূপমণ্ডুকতা, গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবেও দেখা হয় এই কর্মসূচিকে।

গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে এ শোভাযাত্রার সূচনা হয়েছিল, পরে তা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম পায়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় এই কর্মসূচি।

শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বলেন, “গত দুই বছর আমরা এ উৎসবটি করতে পারিনি। এ উৎসবে আমাদের প্রত্যাশা, দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান যে শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি, তা দূরীভূত হোক।

“আমরা মনে করি আমাদের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিশ্চয়ই আমরা বিজয়ী হব। দেশবাসীর প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল।”