ভিকারুননিসা নুন স্কুল
অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হামিদা আলী এখন নিজেই গড়ে তুলেছেন সাউথ পয়েন্ট স্কুল
অ্যান্ড কলেজ৷
শ্রেণিকক্ষের আলোচনার সূত্র
ধরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের স্কুল শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের কারাবাসের
প্রেক্ষাপটে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামিদা আলী খোলামেলা কথা বলেছেন বর্তমান
সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান শিক্ষা, ধর্ম, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে৷
ডয়চে ভেলে: ছাত্র- শিক্ষক সম্পর্কের মূল ভিত্তি কী?
সেটা কি নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে?
হামিদা আলী: একদম নড়বড়ে
হয়ে গেছে। বলতে খারাপ লাগে, আমি একজন প্রিন্সিপাল, একজন শিক্ষক। ছাত্রদের শেখাই, পড়াই।
কিন্তু সেই দিনগুলো পাল্টে গেছে। মানুষ আর মানুষকে ভালোবাসে না। মানুষ কথা বলতে চায়
না। মনের সুখ-দুঃখ মনের ভেতরেই রাখে। এটা একটা মস্ত বড় সমস্যা।
এর কারণ কী?
সামাজিক বিশৃঙ্খলা। আমরা
একজন খাচ্ছি। আরেকজন খেতে পারছেন না। একজন পরছেন, আরেকজন পরতে পারছেন না। একটা অস্বাভাবিক
পরিস্থিতির মধ্যে আছি আমরা।
শিক্ষার্থীরা কী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিখবেন, না
পরিবারেরও ভূমিকা আছে?
পরিবারের ভূমিকা অনেক।
কারণ শিক্ষকদের কাছে তারা কতক্ষণ থাকে? আমরা শিক্ষকেরা শিক্ষা দিই। কিন্তু মা-বাবা
যদি সেটা তাদের পালন করাতে চেষ্টা না করে তাহলে তো আমাদের শিক্ষা বিফলে যায়।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তো বহুমুখী? বাংলা, ইংলিশ,
মাদ্রাসা। এটা কোনো সংকট তৈরি করে?
না, এটা (বাংলা, ইংরেজি)
সংকট তৈরি করছে না, তবে অনেক মাদ্রাসা সংকট তৈরি করছে। আমি মনে করি সেসব মাদ্রাসা বন্ধ
করে দেওয়া উচিত। আমাদের ওই এলাকায় তিনটি মাদ্রাসা। তার মধ্যে মহিলা মাদ্রাসা একটা।
সেখানে ছোট্ট একটা বাচ্চাকে যন্ত্রণা দিয়ে আধমরা করা হয়েছে। আল্লাহ যেন তার বিচার করে।
এগুলোর কোনো বিচার হচ্ছে না। চারদিকে অনাচার। এই জন্য আমার মনে হয়, দেখে-শুনে মাদ্রাসা
করা। যেখানে সত্যিকার কোরআন শিখবে, সব কিছু শিখবে, জীবনের নানা অর্থ খুঁজে বেড়াবে।
আল্লাহকে আমরা খুঁজব, রসুলকে (সা.) আমরা খুঁজব, কবরের চিন্তা করব- এসব কিচ্ছু নাই এখন।
সেজন্যই আমি মনে করি, আল্লাহ আমাদের সবক দিন। আল্লাহ তাদেরও সবক দিন। তারা যেন এইগুলো
থেকে বিরত থাকে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কুশিক্ষার কোনো উপাদান আছে?
কুশিক্ষা সর্বত্র। এখন
কুশিক্ষা আগে আসে। আমরা সুশিক্ষা পরে বলি। কুশিক্ষা যদি একবার দিয়ে ফেলা হয় তখন সে
আর সুশিক্ষা গ্রহণ করে না।
বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব আছে?
না, নেই। বিজ্ঞানই তো ধর্ম।
বিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দেয়। আবার জন্মেছি আল্লাহর হাতে, মরে যাব আল্লাহর কাছে ফিরে
যাব। কী নিয়ে ফিরে যাব সে চিন্তাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
তাহলে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল যে পরিস্থিতির শিকার
হলেন তার দায় কার?
সমাজের সবার। তারা সাহস
পেল কীভাবে? সমাজে তারা দেখেছে, শুনেছে। দেখেছে অন্যরা করে, তাই ভেবেছে আমরাও করব না
কেন? এটা ঠিক না করা গেলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার।
একজন বিজ্ঞান শিক্ষক কী বিজ্ঞান পড়াতে পারবেন না?
নিশ্চয়ই, অবশ্যই পারবে।
সকল শিক্ষার মূল বিজ্ঞান। আমরা জ্ঞান আহরণ করি এই বিজ্ঞান থেকে। সুতরাং জ্ঞান আহরণের
জন্য আমাদের বিজ্ঞান পড়তেই হবে।
শিক্ষার্থীদের যে ভূমিকা, তারা কী এটা নিজেরা করেছে?
না তাদের ব্যবহার করা হয়েছে?
তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাদের ব্যবহার করে এই দিকে অনুগামী করা হচ্ছে। সমাজটা নষ্ট করা হচ্ছে। বাচ্চাদের মন
বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। এসব কাজ যতদিন বন্ধ না হবে ততদিন
আমাদের দেশের কোনো উন্নতি হবে না।
আপনি নিজেও তো একজন শিক্ষার্থী ছিলেন, সেই সময়ে শিক্ষার
পরিবেশ কেমন ছিল?
অনেক ভালো ছিল। আমরা বেতের
বাড়ি খেয়ে শিক্ষা নিয়েছি। তারপরও পরিবেশ ভালো ছিল। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেক ভালো
ছিল।
এখন কী অবনতি ঘটেছে?
অনেক অবনতি ঘটেছে। কেউ
কারুর ভালো চায় না। কেউ কাউকে দেখতে পারে না। ভালো পরিবেশ তৈরি করে না। সবাই নিজের
চিন্তা করে। আমি খাই, আমি খাই, একটা ভাব।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এমন কী কিছু আছে যা
প্রকৃত শিক্ষা বাদ দিয়ে কুসংস্কার ছড়ায়?
যার শিক্ষা আছে সে কখনো
কুসংস্কারের দিকে যাবে না। শিক্ষা আলো ছড়ায়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা নানা ধারার। একমুখী
নয়। একমুখী চিন্তা করতে পারছে না। ফলে নানা কুসংস্কার আছে শিক্ষার নামে।
শিক্ষার মূল ভিত্তি কী হবে?
বলিষ্ঠতা। যে কোনো শিক্ষার
মূল ভিত্তি হলো বলিষ্ঠতা। আমি যেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পারি আমি শিক্ষাবিদ। আমি যেন বলতে
পারি শিক্ষা জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ শিক্ষাই হলো জীবনের মূলমন্ত্র। ভাল থাকার
মূলমন্ত্র।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মূল ভিত্তি কী?
ভালোবাসা, স্নেহ,আদর। তাদের
চরিত্রটা গঠন করে দিতে হবে। কাউকে আমরা কষ্ট দেব না। সৎ জীবন যাপন করব। সুখে-দুঃখে
আমরা এক সাথে থাকব।