ক্যাটাগরি

শিক্ষক পরিচয়ে ২১ বছর পালিয়ে ছিলেন জঙ্গি শফিকুর

বৃহস্পতিবার বর্ষবরণের দিন তাকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, শফিকুর নাম পাল্টে হন আব্দুল করিম। নরসিংদীর বিভিন্ন মাদ্রাসায় এ নামে শিক্ষকতা করেন। ছদ্মনামেই ওই এলাকার একটি মসজিদে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে ইমামতি করতেন।

“রমনা বটমূলে হামলার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত সে আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। ২০০৮ থেকে নরসিংদীতে একটি মাদ্রাসায় কাজ শুরু করে।”

৬১ বছর বয়সী মুফতি শফিকুর রহমান ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাতেও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আত্মগোপনে থেকে ইমামতির আড়ালে ধর্মের নামে ‘বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা প্রচার করতেন’ এই জঙ্গি নেতা।

বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় শফিকুরের সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরে কমান্ডার মঈন বলেন, ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানাধীন বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় তিনি ‘সম্পৃক্ত ছিলেন’। বৈদ্যের বাজারে হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত এবং কমপক্ষে শতাধিক আহত হন।

লুকিয়ে থাকা অবস্থায় শফিকুরঅত্যন্ত কৌশলে’ মাঝে মধ্যে বিভিন্ন স্থানে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতেন বলেও জানান এই র‌্যাব কর্মকর্তা।

“২১ বছর তিনি এভাবেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে চলে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন। পরিবার বলতে শফিকুর রহমান তার ছেলের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা করত; এই পয়েন্ট থেকেই তাকে চিহ্নিত করা হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয়।”

র‌্যাব জানায়, শফিকুর কিশোরগঞ্জে নিজের গ্রাম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকার চকবাজারের একটি মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।

হেদায়া পাস করার পর ১৯৮৩ সালে ভারতে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পড়েন। তারপর বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

পরে ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে ইউসুফ বিন নুরী মাদ্রাসায় ফতোয়া বিভাগে ভর্তি হয়ে তিন বছরের ইফতা (ফতোয়া) কোর্স শেষ করেন।

খন্দকার মঈন বলেন, “১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে অবস্থানকালীন সে আফগানিস্তানে চলে যায় এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করে। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে ফিরে শফিকুর ঢাকার খিলগাঁও একটি মাদ্রাসায় পার্ট টাইম শিক্ষকতা শুরু করে। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউনে লেখাপড়া করার সময় মুফতি হান্নানের সঙ্গে পরিচয় হয়। হান্নানও সেখানে পড়তে গিয়েছিলেন।

“পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে গেলে সেখানে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। আফগানিস্তান থেকে দেশে এসে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করেন। পরে ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে সমমনাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এবং দাওয়াতের কাজ শুরু করেন তারা।”

মঈন বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত শফিকুর হরকাতুল জিহাদ (বি) এর প্রচার সম্পাদক ছিল। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সে হরকাতুল জিহাদের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন শুরা সদস্য।

২০০১ সালে রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালালে ১০ জন নিহত হয়। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে আঘাত হানতে মৌলবাদী গোষ্ঠী সেই হামলা চালিয়েছিল বলে পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।

হামলার পর ওই দিনই নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন।

দুই মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ১৪ জঙ্গিকে আসামি করা হয়।

ঘটনার প্রায় আট বছর পর দুই মামলায় ১৪ জনকে আসামি করে ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকার আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

হত্যা মামলায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দায়রা জজ রুহুল আমিন প্রধান আসামি মুফতি হান্নানসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন।

মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে মুফতি হান্নানের সঙ্গে শফিকুর ছিলেন। অন্যরা হলেন- আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার ও আবদুল হাই।

দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে তাজউদ্দিন, বদর, হাফেজ জাহাঙ্গীর, শফিকুর ও আব্দুল হাই পলাতক ছিলেন। তার মধ্যে শফিকুর এখন ধরা পড়লেন।

সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার মামলায় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

রমনায় হামলার তিন বছর পর ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট পল্টনে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। তাতে ২৪ জন নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়।

ওই মামলায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ যে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়, তার মধ্যে এখন ধরা পড়া শফিকুরও একজন।

আরও খবর

রমনা বটমূলে বোমা হামলার ফাঁসির আসামি গ্রেপ্তার