বৃহস্পতিবার থেকে আবার পানি বাড়া শুরুর পর শনিবার সকাল ৯টা নাগাদ হাওরের প্রধান নদী ধনুর পানি খালিয়াজুরী বাজার পয়েন্টে বিপৎসীমার মাত্র ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বয়ে যায়।
তবে এ জেলায় এরই মধ্যে ৫৪ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এফএম মোবারক আলী।
এখন দুশ্চিন্তার মধ্যে চলছে বাকি জমির ফসল তোলার যুদ্ধ। আবার ফসল শুধু কাটলেই হবে না। সেদ্ধ করে শুকিয়ে ঘরে তোলা আরেক মহাযজ্ঞ। সেই কাজে নেমেছে নারীদের পাশাপাশি শিশু শিক্ষার্থীরাও।
কৃষি কর্মকর্তা মোবারক আলী বলেন, এবার এ জেলায় সরকারি ৩৯৪টি হারভেস্টার যন্ত্র দিয়ে চলছে ধান কাটার কাজ। একরপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ মণ ধান পাচ্ছেন কৃষক এবার। তারা ইতোমধ্যেই উৎপাদিত ধান গোলায় তুলতে শুরু করেছেন।
সম্প্রতি ভারতের মেঘালয়ে অতিবৃষ্টির ফলে পানির চাপ বেড়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন হাওরে। কোথাও কোথাও ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে ভরাডুবি হয়েছে অনেক কৃষকের। তাই ৮০ শতাংশের বেশি ধান পেকে গেলেই তারা শুরু করছেন ফসল ঘরে তোলার কাজ।
জেলার হাওর এলাকায় এবার ধান আবাদ হয়েছে ৪০ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে
জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার গছিখাই গ্রামের শহিদুল মিয়া বলেন, “নিচা ক্ষেতে বি-২৮ ধান লাগাইছিলাম। এইগুলা কাইট্যাইলছি। অহন হাইব্রিড কাটতাছি। হাওরের পানি বাড়তাছে। কিচুটা দুশ্চিন্তা আছেই। হাইব্রিড একেবারে শতভাগ না পাকলেও পানির ডরে কাইট্যাইলছি।”
কৃষি কর্মকর্তা মোবারক আলী জানান, এরই মধ্যে নিচু জমির আগাম জাতের ব্রি-২৮ ধান কাটা শেষ হয়েছে; জমিতে রয়ে গেছে ব্রি-২৯। তাই এখনও ফলসহানির আশঙ্কা থেকে মুক্ত না হাওর পারের কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী:
> জেলার হাওর এলাকায় এবার ৪০ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিত বোরো আবাদ হয়েছে
> উফশী ব্রি-২৮ চাষ হয়েছে ১৮ হাজার ৫০০ হেক্টরে
> হাইব্রিড ১১ হাজার ৯০০, ব্রি-২৯ চাষ হয়েছে ৭ হাজার হেক্টরে
> বাকি জমিতে চাষ হয়েছে স্থানীয় ধান।
কৃষি কর্মকর্তা মোবারক আলী বলেন, এবার উৎপাদন লক্ষ্য ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার মেট্রিকটন ধান। তার মধ্যে উফশীতে হেক্টরপ্রতি গড়ে ধরা হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ১৫ মেট্রিকটন, হাইব্রিড ৭ দশমিক ৩৭ মেট্রিকটন আর স্থানীয় জাত ধরা হয়েছে তিন মেট্রিকটন।
শনিবার সকাল ৮টা নাগাদ হাওরে আবাদের ৫৪ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ১২ দিন আগে ধান কাটা শুরু হলেও গত চার থেকে পাঁচ দিন ধরে শুরু হয়েছে পুরোদমে। প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ ধান কাটা হচ্ছে। সাত থেকে আট দিনের মধ্যে নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার লক্ষ্যে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চাষিদের দম ফেলার সময় নেই। অনবরত চলছে কাটাই-মাড়াই, সেদ্ধ করা ও শুকানোর কাজ।
প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ ধান কাটা হচ্ছে, এরপর সেদ্ধ করে শুকানোও হচ্ছে
খালিয়াজুরীর আউয়াল মিয়া বলেন, “আশা করতাছি এইবার যেবায় হউক, ধান ঘরে তুইল্যা ফালাইতাম পারবাম।”
ধান কাটা বা শুকানোর কাজে বাড়ির কেউ বসে নেই বলে জানান উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের ইসমাইল মিয়া।
“আমরা বেহেই অহন ধান কাটতাছি। বাড়ির বেহেই ধান কাটায় আছে। কেউ ক্ষেতে ধান কাটতাছে, কেউ ধান সেদ্ধ করতাছে। শুকাইতাছে। বেহেই কামের মধ্যেই আছে।”
যে গতিতে ধান কাটা চলছে তাতে পানি কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বলে আশা করছেন জগন্নাথপুরের নুর মিয়া।
তিনি বলেন, “বাইরে থেইক্যা ধান কাটার শ্রমিক আইছে। হেরাও কাটাতাছে। হারভেস্টার মেশিনেও ধান কাটতাছি। নিচের জমির ২৮ ধান কাইট্যা শেষ কইর্যাইলছি।কিচুটা উঁচু ক্ষেতের হাইব্রিড কাটতাছি। আর কিচু ২৯ লাগাইছিলাম। এইডিও চাইর থেইক্যা পাঁচ দিনের মধ্যে কাইট্যালাম আশা করতাছি।
“পানি বাড়তাছে। তয় মনে অয় আমরারে পানি লাগাল পাইবো না।”
খালিয়াজুরী উপজেলার গছিখাই গ্রামের মেহেরবানু ব্যস্ত সময় পার করছেন ধান সেদ্ধ করা নিয়ে। সঙ্গে আছে তার দুই শিশুসন্তান।
তিনি বলেন, “দম পালানিরও সময় নাই। ধান সেদ্ধ কইর্যা শুকাইতাছি। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি আয়ে। রোদ উডে। এইতার মধ্যেই ধান ঘরে নেয়ন লাগে। আমরার ঘরের বেহেই কাম করতাছি।
“আমার মেয়েডা সেভেনে পড়ে। ছেলেডা ফাইভে পড়ে। হেরাও ধান তোলায় কাম করতাছে। আমি একলা না। হাওরের বেক বেট্যাইনই (নারী) অহন ধান তুলতাছে। ধান না তুললে হারা বছর আমরা কী খায়াম।”
তবে এখনও ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে আছে বলে জানিয়েছেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এমএল সৈকত।
নারীরা সংসারের কাজ সামলে দিনভর ব্যস্ত থাকছেন ধান শুকানোর কাজে
তিনি বলেন, “শনিবার সকাল ৯টা নাগাদ হাওরের প্রধান নদী ধনুর পানি খালিয়াজুরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। তাছাড়া জেলার ৩৬৫ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধের পুরোটাই এখনও নিরাপদ আছে।”
বাঁধ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের গঠন করা আটটি দলের সবাই বাঁধ এলাকায় আছেন বলে তিনি জানান।
টিম সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার সচেতন মানুষও তৎপর আছে। সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। তারা আশা করছেন কোনো সমস্যা হবে না।
দিন কয় আগে উজানের ঢলে নেত্রকোণার হাওরের প্রধান নদী ধনুর পানি বেড়ে খালিয়াজুরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে ১০৭ হেক্টর জমির বোরো ফসল নষ্ট হয় বলে কৃষি সম্প্রসাণ অধিদপ্তরের তথ্য।
জেলার কীর্তনখোলা বাঁধে একাধিক ফাটল দেখা দিলে কৃষক, পাউবো ও প্রশাসনের লোকজন দিনরাত কাজ করে; মেরামত করে সেই বাঁধ। ভাঙন ঠেকিয়ে হাওরের অন্তত ১২ হাজার হেক্টর জমির ফসল রক্ষা হয়।
এছাড়া ভারি বৃষ্টির কারণে হাওর অধ্যুষিত নেত্রকোণা, সিলেট ও কিশোরগঞ্জে ঝুঁকিতে থাকা পাকা ধান দ্রুত কাটার পরামর্শ এসেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে।