ক্যাটাগরি

মস্কভার সঙ্গে রাশিয়ার সম্মানও কতটা ডুবল?

সোভিয়েত আমলের মিসাইল ক্রুজারটিতে বুধবার আগুন ধরে গেলে রাশিয়া দাবি করে, জাহাজটিতে রাখা গোলাবারুদে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। আর ইউক্রেইনের দাবি ছিল, তাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধজাহাজটিতে আঘাত হেনেছে।

‘কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজটি’ ধ্বংস হওয়ায় যুদ্ধে রাশিয়ার নৌবাহিনীর কী ক্ষতি হল, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে কি না, কিংবা এই ঘটনা ইউক্রেইনে রাশিয়ার ‘আগুনে ঘি’ ঢালবে কি না, তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে বার্তা সংস্থার রয়টার্সের প্রতিবেদনে।

এক নজরে মস্কভা

>> তৈরি হয়েছিল ইউক্রেইনে, তখন দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল।

>> গত শতকের ৮০ এর দশকে রুশ নৌবহরে যুক্ত হয়েছিল এই রণতরী।

>> মোট ক্রু ৫১০ জন।

>> দৈর্ঘ্য ১৮৬.৪ মিটার।

>> গতি ঘণ্টায় ৩২ নটিক্যাল মাইল বা ৫৯ কিলোমিটার।

>> এতে রয়েছে একটি হেলিকপ্টার।

রাশিয়া কোন সক্ষমতা হারাল?

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। সেখানে দেশটির শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু মস্কভা পুরো কৃষ্ণসাগরে দূরবর্তী মিশনের বিমান প্রতিরক্ষা সুরক্ষা দিয়ে আসছিল, যার ভাসমান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ছিল।

এই জাহাজ ডুবে যাওয়ার ফলে কৃষ্ণসাগরে নৌবহরের বিমান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে, বিশেষ করে দূরপাল্লার মিশনের ক্ষেত্রে।

ক্রুদের ভাগ্যে কী ঘটেছে?

জাহাজটিতে প্রায় ৫০০ নাবিক ছিল। রাশিয়া বলেছে, শুক্রবার ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপল বন্দরে ফিরে আসার আগে সফলভাবে তাদের অন্য জাহাজে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ইউক্রেন বলেছে, জাহাজটিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রাশিয়া এ বিষয়ে কিছু জানায়নি এখনও।

রাশিয়ার নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ মস্কভা।  ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ মস্কভা।  ফাইল ছবি: রয়টার্স

সংঘাতের গতিপথ পরিবর্তন করবে?

রয়টার্স লিখেছে, সম্ভবত না। কিন্তু ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, এই ক্ষতির ফলে রাশিয়াকে কৃষ্ণ সাগরে তার নৌবহরের অবস্থান পর্যালোচনা করতে ভাবাবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, জাহাজডুবির ঘটনায় প্রতীকী প্রভাব থাকবেই। এর ফলে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী নৌ সক্ষমতা নিয়েও সম্ভাব্য প্রশ্ন উঠবে।

তাদের দাবি, তবে এই ঘটনা সংঘাতের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলবে না। রাশিয়ান নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত বড় কোনো ভূমিকা পালন করেনি।

এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়া তার যুদ্ধজাহাজগুলোকে সীমিত আকারে ব্যবহার করেছে। মাঝেমধ্যে হামলা চালাতে এবং দক্ষিণে সৈন্য পাঠাতে ব্যবহার করছে। রাশিয়া জরুরি অঞ্চলে নৌ আধিপত্য বজায় রেখেছে। সমুদ্রে শত্রু জাহাজ ধ্বংস করতে মস্কভাকে সুসজ্জিত করা হয়েছিল।

রুশ নৌবাহিনী গতিপথ পরিবর্তন করবে?

রয়টার্স লিখেছে, রুশ বাহিনী গতিপথ পরিবর্তন করবে। কিন্তু সেই পরিবর্তনকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখা হচ্ছে না।

মস্কভাতে আগুন ধরে গেলে মার্কিন কর্মকর্তারা একে ইউক্রেইনের আক্রমণ বলে মনে করেন। কৃষ্ণ সাগরের উত্তর অংশে প্রায় পাঁচটি রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ উপকূল থেকে প্রায় ৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে সরে যায়।

কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন যে তারা বিশ্বাস করেন, এই জাহাজগুলো এখনও সেই দূরত্ব থেকে ইউক্রেইনে হামলা চালাতে সক্ষম। আবার উপকূল থেকে অনেক দূরে থাকায় ইউক্রেইনীয়দের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলেছে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজকে আঘাত করার ক্ষমতা রুশ নৌবাহিনীকে তার সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত বিমান প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য সম্পদ মোতায়েন করতে বাধ্য করতে পারে।

ইউক্রেইনের এমন ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মস্কভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে।

ইউক্রেইনের এমন ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মস্কভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে।

মস্কভার সুনির্দিষ্ট কী কাজ ছিল?

এ বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তবে কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এটি সম্ভবত ইউক্রেইনের বন্দর ওডেসায় রাশিয়ার সম্ভাব্য উভচর যুদ্ধযান মোতায়েনের জন্য রাখা হয়েছিল, যদি ইউক্রেইনের প্রতিরোধের মুখে এখন পর্যন্ত সেরকম কিছু ঘটেনি।

জাহাজটি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় ওই অঞ্চলে এ ধরনের হামলার সম্ভাবনা কমিয়েছে এবং ইউক্রেইনকে অন্যান্য জায়গায় পুনরায় মোতায়েনের সুযোগ দিয়েছে।

মস্কভার জায়গা প্রতিস্থাপন করা যাবে?

এ ক্ষেত্রে বলা যায়, না। কারণ একই রকম রাশিয়ার আরও দুটি জাহাজ রয়েছে মার্শাল উস্তিনভ এবং ভারিয়াগ নামে।

এ দুটি জাহাজ যথাক্রমে রাশিয়ার উত্তর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের সঙ্গে কাজ করে। বসফরাস হয়ে কৃষ্ণ সাগরে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণকারী তুরস্ক যুদ্ধের সময় ওই জাহাজগুলোকে প্রবেশ করতে দেবে না।

বিরল অস্ত্রসজ্জিত ছিল?

রয়টার্স লিখেছে, সেরকমটি নয়। এতে জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছিল।

রাশিয়ার সর্বশেষ প্রজন্মের কালিব্র ক্রুজ মিসাইল বা হাইপারসনিক মিসাইল দিয়ে সজ্জিত ছিল না মস্কভা।

ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপল বন্দরে নোঙর করা রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ মস্কভার স্যাটেলাইট ছবি। ছবি: রয়টার্স

ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপল বন্দরে নোঙর করা রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ মস্কভার স্যাটেলাইট ছবি। ছবি: রয়টার্স

আধুনিক জাহাজ ছিল?

খুব বেশি না। এর নকশা করা হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময় ১৯৭০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে।

এটি মার্কিন বিমানবাহী যানকে ধ্বংস করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং প্রায় চার দশক সেবায় ছিল। জাহাজটিতে ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে।

ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২১ সালে কার্যক্ষম অবস্থায় ফিরেছে। মেরামত সত্ত্বেও এর কিছু হার্ডওয়্যার পুরনোই ছিল।

রুশ বাহিনীর সম্মান কতটা ডুবেছে?

জাহাজটি পুরনো হলেও কৃষ্ণ সাগরের নৌবহর ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর গর্ব ছিল। এটি বিস্ফোরণে ডুবে যাওয়ার ফলে রুশ বাহিনীর বড় ক্ষতিই হয়েছে।

যদি এটি ইউক্রেনের জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয় তবে ১৯৪১ সালের পর রাশিয়ার সবথেকে বড় ধ্বংসপ্রাপ্ত যুদ্ধজাহাজ হবে। এর আগে সেই সময়ে জার্মান বোমারু বিমানগুলো ক্রনশটাড্ট বন্দরে সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ মারাটকে বিকল করে দিয়েছিল।

ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাটি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) এর মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হোক আর দুর্ঘটনার কারণে মস্কভা ডুবে যাক, এটি ‘ইউক্রেইনের বিজয়ের প্রধান প্রপাগান্ডা।’

পশ্চিমা কূটনীতিক এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাহাজটি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় কৃষ্ণ সাগরে নৌবহরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাকরি হারাবেন।