ষাটের দশকের ‘হার্টথ্রব’ নায়িকা সারাহ বেগম কবরীর বিপরীতে ‘মাসুদ রানা’ সিনেমায় চিত্রনায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল সোহেল রানার; শনিবার কবরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন সোহেল রানা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে এ অভিনেতা বলেন, “যুগের পর যুগ পেরোলেও ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে কবরী আর আসবে না। তার সঙ্গে তুলনা করার মতো কাউকে আমি দেখি না। কবরী আনপ্যারালাল হিরোইন।“
তারকা কবরীর বিপরীতে নায়ক হিসেবে তরুণ সোহেল রানার অভিষেক ঘটে সত্তরের দশকে; ১৯৭৪ সালের ২৪ মে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্রে। ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনা ও পরিচালনাও করেছিলেন সোহেল রানা।

পরবর্তীতে ‘রংবাজ’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কবরীকে লাস্যময়ী হিসেবে দেখা গেলেও ষাট ও সত্তরের দশকের দর্শকের কাছে তার মূল আবেদন ছিল বাড়ির পাশের মিষ্টি মেয়ে রূপে।
কবরীর মাঝে দর্শকরা আবহমান বাংলার চিরায়ত নারীর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিলেন বলে মনে করেন সোহেল রানা; তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে সাধারণ দর্শক তাকে ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে অভিহিত করেছিলেন।
সোহেল রানার ভাষ্যে, “সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরী আমাকে ‘ড্যাশিং হিরো’, রাজ্জাককে ‘নায়করাজ’ উপাধি দিয়েছিলেন। এরপর যারা উপাধি পেয়েছে তারা নিজেরা নিজেরা নিয়েছে। একমাত্র শিল্পী হিসেবে কবরীকে সাধারণ মানুষ উপাধি দিয়েছে।
“রিকশাচালক থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক, মজুররা ‘মিষ্টি মেয়ে’ উপাধি দিয়েছিল। একজন শিল্পী কোন পর্যায়ে গেলে দেশের সাধারণ মানুষ তাকে উপাধি দেয়। এর চেয়ে বড় পাওয়া একজন শিল্পীর কাছে হতে পারে না। সে (দর্শক) হয়তো অনেক কিছুই বোঝে না কিন্তু কবরীকে পর্দায় দেখে ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলছে; যা হৃদয় থেকে ভালোবাসার প্রকাশ। কবরী যেটা পেয়েছে সেটা বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সেটা কেউ পায়নি।”
ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে বেড়ে উঠা ভীরু ডাগর চোখের কিশোরী মিনা পাল মাত্র ১৪ বছর বয়সে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় যাত্রা শুরু করেন।
কয়েক বছরের ব্যবধানে নির্মাতা জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘বাহানা’ ও নির্মাতা খান আতাউর রহমানের ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কবরীর ভ্রু’র তালে উত্তাল হয়েছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।

পাঁচ দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘সুজন সখী’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সারেং বউ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’সহ দুই শতাধিক বাংলা চলচ্চিত্রে আলো ছড়িয়েছেন কবরী।
সেই সময়ের শীর্ষ নায়িকা শাবানা, ববিতাদের থেকে কবরী আলাদা কোথায়?-তার একটি ধারণা দিলেন সোহেল রানা।
“বাঙালি নারী বলতে যেটা বোঝা যায়, সেটাই হলো কবরী। বাঙালি নারীর গায়ের রঙ থেকে চলাফেরা, কথা বলার ধরণ-সবমিলিয়ে তিনি পুরোদস্তুর বাঙালি নারীর মতো। তাকে ‘মিষ্টি মেয়ে’ শুধু অভিনয়ের জন্য বলা হয়নি। অভিনয়ের পাশাপাশি প্রকাশিত গুণের কারণে ও ব্যক্তিত্বের জন্য তাকে ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলা হয়। এটার জন্য বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আগামীতে কবে আসবে জানি না, সেটা দেখে যেতে পারব না।”
মাত্র ১৪ বছর বয়সে অভিনয়ের নাম লেখানোর এ নায়িকাকে ‘স্বশিক্ষিত’ হিসেবে ‘জ্বলন্ত প্রমাণ’ বলে মনে করেন সোহেল রানা।
“সে যখন রাজনীতি, দেশ, অর্থনীতি সম্পর্কে কথা বলত তখন মনে করতাম, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছে, প্রশংসিত হয়েছে। তার ক্ষুরধার যুক্তির কারণে অনেকের চেয়ে আলাদা হয়ে ওঠেছিলেন।”
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন কবরী।

সোহেল রানা জানালেন, কবরী ব্যক্তিগত জীবনে বেশ আমুদে ছিলেন; জমিয়ে আড্ডায় দিয়ে চারপাশ মাতিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। কাছের মানুষদের সঙ্গে খুনসুটি করতে ভালোবাসতেন; অবসরে গল্পের বইয়ে ডুবে থাকতেন। আর নতুন কোনও বিষয়ে তার জানার আগ্রহ ছিল প্রবল।
অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনাও করেছেন কবরী; ২০০৬ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’। তার পরিচালনায় শেষ সিনেমা ‘এই তুমি সেই তুমি’-তে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা। কবরীর মৃত্যুর পর সিনেমার কাজ আটকে আছে; বাকি কাজ শেষ করার কথা রয়েছে তার পরিবারের।
অভিনেত্রী কবরী একাত্তরের উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভারতের বড় বড় শহরে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে কাজ করেছেন। সেখানে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। পরে দেশে ফিরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন সিনেমায়।
সেলুলয়েডের সেই রঙিন জীবন শেষে কবরীর পরের জীবন-চলচ্চিত্রও কম বর্ণময় ছিল না। রাজনীতিতে নেমে জীবনের আরেক চলচ্চিত্রের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছিল বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে।
এক সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের বধূ কবরীকে ভোটের মাঠে সেই নারায়ণগঞ্জেই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সব জয় করেই ২০০৮ নবম সংসদে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়েছিলেন তিনি।
স্মৃতির পাতায় থাকুক ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী