এ ঘটনার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দুই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে মন্তব্য করেছিলেন চিকিৎসক। এর ভিত্তিতে বোয়ালিয়া থানা পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও আদালত ঘটনার অধিকতর তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেয়।
পিবিআইর দেড় বছরের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আত্মহত্যা নয়, সেটা ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজের ছাত্র আহসান হাবিব ওরফে রনি, রাজশাহী কলেজের ছাত্র বোরহান কবির উৎস ও আল আমিন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদকে গ্রেপ্তার করাহয়। রনি ও উৎস আদালতে জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।
পিবিআই বলেছে, ‘ত্রিভুজ প্রেমের’ কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যার আগে তারা ওই ছাত্রীকে ধর্ষণও করেছিল, পরে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটিকে মাথায় আঘাত এবং ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই অন্তত ২৪টি মামলা পেয়েছে, যেগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনের ভিন্নতা পাওয়া গেছে।
দেশের মর্গ ব্যবস্থাপনার দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে নির্ভুল ময়নাতদন্তের স্বার্থে পিবিআই কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে ১১টি সুপারিশ করেছে।
পুলিশের বিশেষায়িত শাখাটির প্রধান, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার জানান, সুপারিশমালা বর্তমানে পুলিশ সদরদপ্তরে রয়েছে, সেখান থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
৭২ পৃষ্ঠার এ সুপারিশমালা ও প্রতিবেদনে পিবিআই’র পক্ষ থেকে ১২টি হত্যাকাণ্ডের বিবরণ উল্লেখ করেছে, যেগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসক ‘আত্মহত্যা’ বলে মতামত দিয়েছিল। যার ওপর ভিত্তি করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামলাগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশে পুনঃতদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই প্রমাণ পেয়েছে সেগুলো ছিল হত্যাকাণ্ড।
বনজ মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতের নির্দেশে বেশকিছু মামলার অধিকতর তদন্ত করতে গিয়ে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ত্রুটির প্রমাণ পেয়েছি এবং যেগুলোতে চিকিৎসক আত্মহত্যা বললেও তদন্তে হত্যার প্রমাণ মিলেছে। তাই ময়নাতদন্তের বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি। এবার অফিসিয়ালি মতামত দিয়েছি।”

বনজ কুমার মজুমদার। ফাইল ছবি
দেশের বর্তমান ময়নাতদন্ত কার্যক্রমের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সুরতহাল, ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে।
মর্গগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ, আলোর ব্যবস্থা, আধুনিক অবকাঠামো ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির অভাব আছে। বর্তমানে অনেক জেলায় দিনের বেলায়ও মোমবাতি জ্বালিয়ে ময়নাতদন্ত করতে হয়। মর্গে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব ও ময়নাতদন্ত বিষয়ে মর্গ সহকারী বা ডোমদের কোনো মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়াও ঢাকাসহ ব্যস্ত মর্গগুলোতে ডোম স্বল্পতাও অত্যন্ত প্রকট।
লাশ সংরক্ষণে পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব আছে।
মৃতদেহের বিভিন্ন নমুনা বা ভিসেরা সংরক্ষণে মর্গগুলোতে আলাদা কোনো জায়গা নেই। এগুলো সংরক্ষণের জন্য কন্টেইনার বা প্রিজারভেটিভ বা রাসায়নিক সরবরাহ অপ্রতুল, ফলে আলামত নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বেশি।
সংগৃহীত নমুনা বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। এসব ল্যাবরেটরি থেকে রিপোর্ট আসতেও দেরি বিলম্ব হয়। যেখানে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাবের কথাও বলছে পিবিআই।
সুপারিশে এও বলা হয়, বিদেশি নাগরিকদের মৃতদেহ প্রচলিত নিয়মে হিমঘরে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে। অল্প সংখ্যক মর্গে ফ্রিজিং বা মর্চুয়ারি কুলার সিস্টেম থাকলেও সেগুলো প্রায়ই নষ্ট থাকে, যার কারণে গরমে লাশ দ্রুত পচন ধরে। এ প্রক্রিয়াগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থাপনা বা তাগাদা নেই।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর সম্ভাব্য সময় উল্লেখ থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে গত বছরের জুন মাসে ঢাকায় নিজ বাসায় চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি খুনের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়।
ওই মামলায় খুনের ধরন স্পষ্ট হলেও খুনের সম্ভাব্য সময় জানার জন্য পিবিআই থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হলে ময়নাতদন্ত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি স্পষ্টকরণে অপারগতা প্রকাশ করেছিল বলেও উল্লেখ করা হয় এ প্রতিবেদনে।
মেডিকেল কলেজগুলোতে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসকদের কাজ করার আগ্রহ কম এবং অধিকাংশ স্থানে ‘জোড়াতালি’ দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়; যে কারণে চিকিৎসা শিক্ষায় এ শাখাটি অত্যন্ত অবহেলিত বলেও পিবিআই তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
পিবিআই তাদের এ সুপারিশমালায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হওয়ার নয়টি সম্ভাব্য কারণও উল্লেখ করেছে।
এগুলোর মধ্যে আছে- ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের একটি বৃহৎ অংশের ফরেনসিক বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা। ব্যস্ত মর্গগুলোতে লাশের সংখ্যার আধিক্যের কারণে পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ময়নাতদন্ত কাজ সম্পাদন করা।
ময়নাতদন্ত সম্পাদনের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও হিমাগারসহ স্থাপনা/অবকাঠামো না থাকা, ময়নাতদন্ত কাজে সহায়তাকারী ডোম স্বল্পতা ও তাদের সুনির্দিষ্ট নিয়োগবিধি না থাকা। ডোমদের মৌলিক প্রশিক্ষণের অভাব ও তাদের ওপর ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তাদের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা।
চাঞ্চল্যকর ও জটিল মৃতদেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত না করা, ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সংগৃহীত আলামত যথাযথ সংরক্ষণের সুবিধা না থাকাকেও দুর্বল ময়নাতদন্তের কারণ হিসেবে দেখছে পিবিআই।
দেড় বছর পর ধর্ষণ ও খুনের মামলার কিনারা
এছাড়া আদালতে সাক্ষী হওয়ার অনীহায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ময়নাতদন্ত কাজে অংশ না নেয়া এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
পিবিআই বলছে, একটি হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক তদন্ত থেকে শুরু করে বিচারকাজ চলা পর্যন্ত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একসময় লাশের ময়নাতদন্ত দিনের আলোয় করার বাধ্যবাধকতা ছিল, এখন বৈদ্যুতিক আলোতে তা করা হয়। কিন্তু কার্যক্রমের দিক থেকে বছরের পর বছর লাশকাটা ‘অন্ধকারে’ রয়ে গেছে।

পিবিআই বলছে, ময়নাতদন্তের জন্য নির্ধারিত চিকিৎসকদের কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যেসব জেলা শহরে মেডিকেল কলেজ নেই, সেসব শহরে আরএমও বা মেডিকেল অফিসাররা ময়নাতদন্ত করে থাকেন; যাদের প্রায় সবার এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে না।
পিবিআই’র সুপারিশ- জেলা হাসপাতালগুলোতে ময়নাতদন্তের কাজ করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় আলাদা পদ তৈরি বা সমন্বয় করে আগ্রহী চিকিৎসকদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই পদের বিপরীতে পদায়ন করা যেতে পারে; যারা ময়নাতদন্তের বাইরে হাসপাতালের স্বাভাবিক সেবায় নিয়োজিত থাকবেন এবং সাধারণ নিয়মে পদোন্নতি পাবেন।
ময়নাদন্তের চিকিৎসকরা অধিকাংশ সময়ে ডোমদের সহায়তা নিয়ে থাকেন। এ ডোমদের দায়িত্ব মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য প্রস্তুত করে ডাক্তারের কাছে উপস্থাপন করা এবং পুনরায় নির্ধারিত স্থানে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা। কিন্তু এ ডোমদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা কাজ শেখেন।
সরকারি হাসপাতালে ময়নাতদন্তে চিকিৎসকদের সহায়তা করার জন্য দুইটি করে ডোমের পদ আছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একজন অনুপস্থিত বা ডেপুটেশনে অন্য বিভাগে কর্মরত থাকেন।
পিবিআই বলছে, দেশের মর্গগুলোতে নারী মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করার জন্য নারী মর্গ সহকারী নেই। সব ক্ষেত্রেই পুরুষ মর্গ সহকারীদের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত হয়, যা নৈতিকতার দৃষ্টিতে আপত্তিকর।
ময়নাতদন্ত স্বচ্ছরূপে সম্পাদন ও মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি হাসপাতালে একজন মর্গ ইনচার্জের নেতৃত্বে নারীসহ পর্যপ্ত মর্গসহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ থাকা প্রয়োজন বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা পানিতে ডুবে, সাপে কামড়ানো হত্যাদি মৃত্যু ছাড়া ফাঁসি, বিষ প্রয়োগ, আগুনে দগ্ধ ইত্যাদি সন্দেহজনক মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে একাধিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত করারও সুপারিশ করা হয়।
যেসব ক্ষেত্রে বাদীর অভিযোগ বা প্রাথমিক তদন্তের ফলাফলের সাথে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বা রাসায়নিক পরীক্ষকের মতামত ভিন্নরূপ হয়, সে ক্ষেত্রে বিশেষ বোর্ড স্থাপন করে চূড়ান্ত মতামত দেয়ারও সুপারিশ করা হয়।
এদিকে সুরতহাল প্রতিবেদনে কোন বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ, কোনগুলো অপ্রাসঙ্গিক সেগুলোর বিষয়ে সুরতহাল প্রস্তুতকারী পুলিশ সদস্যদের প্রাথমিক করণীয়, প্রতিবেদনে ব্যবহৃত শব্দ ও শব্দগুচ্ছের ব্যাখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কে মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ বা সেমিনার আয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়।
এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্টের ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতিমালা ও কবর থেকে লাশ উত্তোলনের জন্য নীতিমালা প্রণয়ণের সুপারিশ করা হয়।
পাশাপাশি আদালতের প্রয়োজনে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ভার্চুয়াল সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়টিও বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করে মেডিকেল কলেজগুলোর সঙ্গে আদালতের আইটি বিভাগের সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয় সুপারিশে।