ক্যাটাগরি

সিএনজি অটোরিকশার লুকিং গ্লাস ভেতরে কেন?

লুকিং গ্লাস ভেতরে থাকায় দুই পাশে পুরোপুরি দেখা যায় না। সেইসঙ্গে পেছনের অংশে অস্বচ্ছ আবরণ থাকায় যানবাহনের গতিবিধি বোঝার উপায় থাকে না। ফলে প্রায়ই ঘটছে ছোটখাট থেকে বড় দুর্ঘটনা।

সিএনজি চালিত অটো রিকশার চালক ও মালিকরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) আদেশেই তারা লুকিং গ্লাস ভেতরে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।

অপরদিকে বিআরটিএ বলছে, এমন কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি।

তাহলে সরকারি আদেশ ছাড়া ঢাকার রাস্তায় অটোরিকশাগুলো এত বছর ধরে আয়না ভেতরে রেখে চলছে কী করে?

গত ১০ বছর ধরে ঠিকমতো না দেখেই কিংবা সামনে ছাড়া আর কিছু না দেখেই রাস্তায় চলাচল করছেন বলে জানালেন ঢাকার সিএনজি অটোরিকশা চালক মিল্লাত হোসেন। 

৪৩ বছর বয়সী মিল্লাত প্রথমে টু স্ট্রোক অটোরিকশা চালানো শুরু করেন জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফোরস্ট্রোক গাড়ি যখন প্রথম নামল তখনও গাড়ির বাইরেই লুকিং গ্লাস ছিল।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

“হঠাৎ সেগুলো ভেতরে ঢোকানোর আদেশ হল। প্রথম প্রথম চালাতে খুবই সমস্যা হতো। এখন সয়ে গেছে।”

এ বিষয়ে পেশাদার মাইক্রোবাস চালক মো. বাবুল বলেন, “ঢাকার রাস্তায় লুকিং গ্লাস ছাড়া গাড়ি চালানো একেবারে অসম্ভব। ডানে-বায়ে, সামনে-পেছনে গায়ে গা ঘেঁষে থাকে গাড়িগুলো।

“প্রতিবারই স্টিয়ারিং সামান্য ডানে-বামে ঘোরানোর আগে লুকিং গ্লাসে দেখে নিতে হয়। কিন্তু কোনো প্রকার লুকিং গ্লাস ছাড়া ঢাকার সিএনজি অটোরিকশাগুলো কী করে ঢাকা শহরে চলছে সেটা এক বিস্ময়!”

বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় এখন ভাড়ায় চালিত ১৫ হাজার অনুমোদিত সিএনজি চালিত অটোরিকশা রয়েছে। ২০০১ সালে টু-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি তুলে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের অটেরিকশা বরাদ্দ দেয় সরকার।

২০০৪ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় ঢাকায় ১৩ হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশার অনুমোদন দিয়েছে বিআরটিএ। পরে ২০১৫ সালে তিন চাকার বাহন মিশুক তুলে দিয়ে আরও দুই হাজার অটোরিকশার অনুমোদন দেওয়া হয়।

ঢাকা শহরের প্রায় শতভাগ অটোরিকশার লুকিং গ্লাসই ভেতরে ঢোকানো। অথচ একই মডেলের অটোরিকশা যেগুলো ভারতে চলছে সেগুলোর লুকিং গ্লাস গাড়ির বাইরে বের করা।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি হাজী বরকতুল্লাহ বুলু বলেন, “এটাতো বাইরেই ছিল। টু-স্ট্রোক অটোরিকশাগুলো ঢাকায় চলেছে প্রায় ৫৫ বছর, তখন লুকিং গ্লাস বাইরেই ছিল।

“এরপর সিএনজি অটোরিকশা আসার পরও ১০-১২ বছর লুকিং গ্লাসগুলো বাইরেই ছিল। হঠাৎ করে বিআরটিএ একটা আদেশ জারি করে এগুলো ভেতরে ঢোকানোর জন্য।”

এর কারণ তুলে ধরে সিএনজি আটোরিকশা মালিকদের এই নেতা বলেন, “কিছু নারী সংগঠন তখন অভিযোগ জানায় যে, চালকরা লুকিং গ্লাসের মাধ্যমে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, উত্যক্ত করেন।

“এরপরেই বিআরটিএ সেগুলো সরিয়ে ভেতরে নিতে বলে। এখন লুকিং গ্লাস ভেতরে ঝালাই করে লাগানো না থাকলে বিআরটিএ ফিটনেস দেয় না।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত ৭ এপ্রিল বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিআরটিএ এরকম কোনো আদেশ বা নির্দেশনা দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। 

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

“কারণ গাড়িতে লুকিং গ্লাস দেওয়াই হয় পেছনের যানবাহন দেখার জন্য। সেটা কাজে না লাগিয়ে ভেতরে রাখা হবে কেন?”

সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি হাজী বরকতুল্লাহর ভাষ্য তুলে ধরে বিআরটিএ পরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে ভেতরে লুকিং গ্লাস রেখে এতগুলো অটোরিকশা চলছে কী করে? 

জবাবে তিনি বলেন, “আপনি বরং ওদের (সিএনজি অটোরিকশা মালিক নেতাদের) বলুন আদেশের কোনো কপি থাকলে সেটা আপনাকে দেখাক।”

বরকতুল্লাহ বুলু অবশ্য এরকম আদেশের কোনো কপি দেখাতে পারেননি। তিনি বলেন, “বিষয়টি অনেক বছর আগের, তাই কাগজটি সংরক্ষণ করা হয়নি।” 

পরে গত সোম ও মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরে বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে কাগজপত্র নবায়নের জন্য যে অটোরিকশাগুলো এসেছে সেগুলোর আয়না গাড়ির ভেতরে ঢোকানো।

চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বেশিরভাগ অটোরিকশাই বিআরটিএ-তে সরাসরি না দেখিয়ে দালালদের মাধ্যমে ফিটনেস নবায়ন করানো হয়। যে কারণে ফিটনেসের লাইনে অটোরিকশা তেমন দেখা গেল না।

অটোরিকশা চালক আমির আলী বিআরটিএ-তে আসেন রুট পারমিট নিতে। তিনি জানান, গত ১০ বছর ধরে আয়না ভেতরে রেখেই চালাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে ফিটনেস নিয়েছেন তখনও আয়না ভেতরে ছিল।

গাড়ির আয়না ভেতরে রেখে ফিটনেস দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ফিটনেস প্রদানকারী কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ১১০ নম্বর কক্ষে যোগাযোগ করতে বললেন।

সেখানে বসেন বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) রুহুল আমিন। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আয়না থাকবে গাড়ির বাহিরে।”

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তাহলে অটোরিকশাগুলো আয়না ভেতরে রেখে চলছে কীভাবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এই সপ্তাহেই মৌখিকভাবে আদেশ দেওয়া হয়েছে, ফিটনেস পেতে হলে গাড়ির আয়না বাইরে রাখতে হবে। এখন থেকে সেভাবেই কাজ চলছে।”

এর আগে গত বছর ৩১ অগাস্ট সিএনজি চালিত অটোরিকশার আয়না ভেতরে না বাইরে থাকবে সে বিষয়ে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের মতামত জানতে চায় হাই কোর্ট।

২০১৮ সালে আইনজীবী তানভীর আহমেদের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত এ আদেশ দেয়। জনস্বার্থে করা ওই রিট আবেদনে আইনজীবী তানভীর আদালতে নিজেই শুনানি করেন। 

আদালতে তিনি বলেন, আইন মোতাবেক গণপরিবহনের সামনের দুই পাশের বাইরের দিকে আয়না থাকার কথা, যেন চালক পেছন দিক থেকে বা পাশ থেকে অন্যান্য যানবাহন চলাচল দেখতে পারেন।