তারা বলছেন, শিগগির যদি আন্তর্জাতিক সাহায্য না মেলে, নিদারুণ এক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখোমখি হতে হবে তাদের দেশের মানুষকে।
এই বিপদের মূল কারণ বিদেশি মুদ্রার সঙ্কট, যে কারণে খাদ্য আর জ্বালানি তেলও আমদানি করা যাচ্ছে না, শ্রীলঙ্কার পুরো অর্থনীতিই ধুঁকছে। এক প্রতিবেদনে দেশটির স্বাস্থ্য খাতের এই দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছে বিবিসি।
রাজধানী কলম্বোর হাসপাতালগুলোতে কোন কোন ওষুধ শেষ হয়ে আসছে, সেই তালিকা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে শ্রীলঙ্কার মেডিকেল স্পেশালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সার্জন ডা. জ্ঞানসেকারম।
বিবিসিকে তিনি বলেন, “দিনকে দিন সব কিছু ফুরিয়ে যাচ্ছে… এখন যদি সব শেষ হয়ে যায়, আমি জানি না কী হবে।
“চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, চেতনানাশক, ইমপ্ল্যান্ট, এমনটি সেলাইয়ের উপকরণেও টান পড়েছে। মজুদ যা ছিল আমরা প্রায় শেষ করে ফেলেছি। পুরো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে যদি শিগগিরই সহায়তা না পাওয়া যায়।”
ঘোরতর সেই বিপদের হুঁশিয়ারি দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “যদি তাই ঘটে, তাহলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে যে আমরা রোগীদের জীবন বাঁচাতে পারব না।”
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর সবচে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়টা পার করছে শ্রীলঙ্কার মানুষ। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থায় ৮৫ শতাংশ রসদই আমদানি করতে হয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে ঠেকায় প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় শিশু হাসপাতাল লেডি রিজওয়ের পরিচালক ভিজেসুরিয়া প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা তৈরি করছিলেন। ওই তালিকায় দেখা গেল, অ্যাট্রাকিউরিয়ামের মতো কিছু ওষুধের মজুদ রয়েছে আর দুই মাসের। এসব ওষুধ রোগীদের চেতনানাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। চেতনানাশক না থাকলে অস্ত্রোপচার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
ছবি: রয়টার্স
হাসপাতালের মজুদে থাকা অন্যান্য ওষুধ আরও কম সময় যাবে। ব্যথানাশক ফেন্টানাইলের মজুদ আছে মাত্র দুই সপ্তাহর। তিনটি ভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের মজুদ এরইমধ্যে শেষ।
ডা. ভিজেসুরিয়া বলেন, আপাতত এক হাসপাতালের ওষুধ আরেক হাসপাতালে নিয়ে কাজ চলছে। আর তারা আশা করে আছেন, সরকার হয়ত কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারবে।
তবে সামনের সারিতে যাদের কাজ করতে হচ্ছে, সেই চিকিৎসকরা খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না। তাদের অনেকের ভাষ্য, সরকার তাদের এই পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে। শুধু ইউনিয়ন প্রতিনিধি এবং হাসপাতালের পরিচালকদের কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসকরা সমস্যার কথা বলার পরও শ্রীলঙ্কা সরকার প্রাথমিকভাবে এক বিবৃতিতে ওষুধ ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। একদিন পর সরকারি তথ্য অধিদপ্তর সেই বিবৃতির সংশোধনী দিয়ে কিছু ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ঘাটতির কথা স্বীকার করে।
ডা. নিশান (ছদ্মনাম) শ্রীলঙ্কার পূর্বাঞ্চলের একটি ক্যান্সার হাসপাতালে কাজ করেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি এমন চললে দুই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের বেশিরভাগ অস্ত্রোপচার বন্ধ করে কেবল জরুরি অস্ত্রোপচারগুলো করা লাগতে পারে।”
আইভি ফ্লুইড, প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবায়োটিকের মতো প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা দেখিয়ে তিনি বলেন, “এমন একটি সময় আসতে পারে, যখন আমাদের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসাও হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে।”
নিশান এসেছেন শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করার অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে এই অর্থনৈতিক সংকট আরও অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।
“যুদ্ধের সময় আমাদের সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু এখন এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও রসদের সরবরাহ নেই। যুদ্ধের সময় আমরা এখনকার মত এতটা হতাশ, এতটা অসহায় ছিলাম না।”
শ্রীলঙ্কা বিনামূল্যে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে, যার ওপর দ্বীপের লাখ লাখ মানুষ নির্ভরশীল।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের একটি হাসপাতালে কাজ করেন কাসুন (ছ্দ্মনাম)। তিনি জানান, সরবরাহ না এলে ওষুধ শেষ হয়ে যেতে মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার।
“আমাদের কাছে যা আছে, তাই দিয়ে চলতে বলা হচ্ছে, কিন্তু এর কোনো বাস্তব সমাধান নেই। আমি অসহায় বোধ করছি।”
দ্বীপের চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন গাভর্নমেন্ট মেডিকেল অফিসারস অ্যাসোসিয়েশন (জিএমওএ) এ সংকটের জন্য দায়ী করেছে অর্থনৈতিক দুর্বলতা আর অব্যবস্থাপনাকে। বিদেশিদের কাছে জরুরি ওষুধ পাঠানোর আবেদন জানিয়েছে তারা।
ছবি: রয়টার্স
সংগঠনটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে রেয়ছে অ্যান্টিবায়োটিক, প্যারাসিটামল, রক্তচাপের ওষুধ এবং অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট।
প্রবাসীরা এই বিপর্যয়ের সময়ে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে; বিশ্বজুড়ে শ্রীলঙ্কার চিকিৎসকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলো ওষুধের উৎস খুঁজছে।
শ্রীলঙ্কার পেরিনাটাল সোসাইটির সভাপতি ডাক্তার সামান কুমারা গত সপ্তাহে একটি ভিডিও প্রকাশ করে নবজাতকদের শ্বাস নিতে সাহায্য করা ‘ইটি টিউব’চেয়ে আবেদন করেন।
হাতে থাকা টিউবগুলো পুনরায় ব্যবহারের জন্য পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
কুমারা বলেছিলেন, “আমাদের প্রায় সমস্ত মজুদ শেষ হওয়ার পথে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নতুন কোনো ইটি টিউব পাওয়া যাবে না।”
তার ভিডিও বার্তা বিশ্বের অন্য চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছাতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তারা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘পর্যাপ্ত পরিমাণে’ ইটি টিউব সাহায্য পেয়েছিলেন বলে জানান কুমারা।
অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ঘাটতির কথাও বলেছেন তিনি। ঘাটতি মেটাতে দাতব্য সংস্থা ‘সেইভ এ বেবির’ সঙ্গে তিনি কাজ করছেন।
স্বাস্থ্যসেবা ঠিক রাখার জন্য সম্প্রতি ডা. আনভার হামদানিকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছে শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তিনিও এ সংকট কাটিয়ে উঠতে কাজ করে যাওয়ার কথা বলেছেন।
শ্রীলঙ্কার ওষুধের বড় যোগানদাতা ও সহায়তাকারী দেশ ভারতসহ অন্যান্য বিদেশি সরকারের সাহায্যের আশা করছেন হামদানি, যাতে ক্রমবর্ধমান সংকট কাটানো যায়।
“আমাদের স্বীকার করতে হবে, এটি একটি কঠিন সময় এবং কিছু জিনিসের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসেনি। স্বল্পমেয়াদী সমস্যাগুলো একবার ঠিক করতে পারলে অর্থায়নের একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে “
শ্রীলঙ্কার চিকিৎসা সংকট আরও জটিল হয়েছে কর্মীদের ওপর চাপের কারণে। কাসুন বলেন, তার হাসপাতালের কর্মীদের বলা হয়েছে, বাজেটে টান পড়ায় ওভারটাইমের টাকা কমানো হবে।
সারাদেশে লাখো ডাক্তার মূল বেতন পেতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালে যেতে গাড়ির জ্বালানি তেলের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
“বেঁচে থাকা খুব কঠিন হয়ে উঠছে, বেতন বাড়ছে না, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশচুম্বী হয়েছে,” বলেন কাসুন।
খাদ্য ও জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্যের প্রতিবাদে লাখ লাখ মানুষের পাশাপাশি ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেল ছাত্ররাও বিক্ষোভ করেছেন। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে ডা. জ্ঞানসেকারন সাহায্যের জন্য বিশ্বের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “আমাদের যে কোনোভাবে রসদ প্রয়োজন; তা অন্য দেশের সরকার হোক, বা ব্যক্তিগত দান হোক।
“পেশাদার হিসাবে আমরা অরাজনৈতিক, কিন্তু আমরা আমাদের রোগীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা কেবল তাদের চিকৎসা করাতে চাই, আমরা চাই না যে তারা মারা যাক।”
আরও খবর
শ্রীলঙ্কা এমন বেহাল কেমন করে হল?
আর্থিক দুর্দশায় শ্রীলঙ্কা, কাগজ সংকটে স্কুলের পরীক্ষাও বন্ধ