অর্থনৈতিক দুর্দশায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা খাবার, ওষুধ ও বিদ্যুতের চরম সংকটে পড়েছেন। যার বিরুদ্ধে সড়কে নেমে প্রতিবাদ করছেন তারা। দেশটির হাসপাতালগুলোতেও এখন করুণ অবস্থা বিরাজ করছে।
ছোট্ট মিরু ব্রেইন টিউমরে আক্রান্ত। প্রায়ই মৃগীরোগীদের মত তার খিঁচুনি হয় এবং কয়েক মিনিটের জন্য সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওই সময় তার খিঁচুনি রোধ করে (অ্যান্টি-কনভালসেন্ট) এমন একটি ওষুধের প্রয়োজন হয়। মিরুর বাবা উপুল চন্দনার জন্য এখন একমাত্র ছেলের জীবন রক্ষা করতে ওই ওষুধ জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
শ্রীলঙ্কায় বর্তমানে যে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে, তার বড় ধাক্কা লেগেছে দেশটির ওষুধ খাতে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সঙ্কট দেখা দেওয়ায় দেশটি বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করতে পারছে না।
সিএনএন-কে উপুল বলেন, ‘‘কোনও হাসপাতালে ওষুধ নেই, ফার্মাসিতেও পাওয়া যাচ্ছে না। টাকা দিয়েও এখন আর ওই ওষুধ জোগাড় করতে পারছি না।”
কয়েক দশকের মধ্যে তীব্রতম অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগছে শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে তারা বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য বা ওষুধ আমদানি করতে পারছে না। এদিকে, কাঁধে বিশাল অংকের ঋণের বোঝা, যার জন্য মোটা অংকের সুদ দিতে হবে।
দেশের ভেতরে মূল্যস্ফীতিও এখন চরমে পৌঁছেছে। নিত্যপণ্যের দাম দেশটির বেশিভাগ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। এজন্য সরকারের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে জনগণ প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তারা আপাতত বিদেশ থেকে আনা ঋণের সুদ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং বেইলআউট প্যাকেজের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)-এর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় হাসপাতালগুলোতে ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। দেশটির এখন যে অবস্থা সেটাকে ‘নজিরবিহীন মানবিক সঙ্কট’ বলে বর্ণনা করেছে সিঙ্গাপুর রেড ক্রস।
চিকিৎসকরা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করছেন। এমনকি, মোবাইল ফোনের লাইট জ্বেলে অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।
যদিও এখন পর্যন্ত ওষুধের অভাবে কারও মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে মানুষের মৃত্যু হয়ত কোভিড মহামারীতে দেশটিতে মারা যাওয়া সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। শ্রীলঙ্কায় কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ১৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার স্টেট ফার্মাসিউটিকাল অ্যাসোসিয়েশন-এর সেক্রেটারি আথুলা আমারাসেনা বলেন, ‘‘এ এমন এক সঙ্কট, যেটি কতটা খারাপ হবে পারে সে সম্পর্কে আমরা অনুমান করতে পারছি না। তবে আমরা এটা বুঝতে পারছি, আমরা আরও তীব্র সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছি।’’
ছবি: সিএনএন ভিডিও
হাসপাতালে শোচনীয় পরিস্থিতি:
ওয়াসান্থা সেনেবীরত্নে প্রতিদিন কলম্বোর বিভিন্ন ফার্মেসিতে হন্যে হয়ে কেমোথেরাপির ঔষধ টপোটেকান খুঁজে বেড়ান। তার সাত বছরের মেয়ের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে ওই ওষুধের উপর।
কিন্তু যে হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করেছেন সেখানে বা অন্য কোনো ফার্মাসিতে তিনি আর ওই ওষুধটি খুঁজে পাচ্ছেন না। সবার এক জবাব, দেশের কোথাও ওই ওষুধটি আর পাওয়া যাচ্ছে না।
অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও হাসপাতালগুলো রোগীদের জন্য বিনামূল্যে টপোটেকান সরবরাহ করত বলে জানান ওয়াসান্থা।
ওয়াসান্থার চেয়েও অসহায় অবস্থায় পড়েছে দেশটির হাসপাতালগুলো। শ্রীলঙ্কান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (এসএলএমএ) থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশটির সব হাসপাতাল এখন জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সঙ্কটে পড়েছে।
চেতনানাশক ও রিএজেন্টের অভাবে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখা হয়েছে। গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কমানো হয়েছে।
পেরিনাটাল সোসাইটি অব শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হাসপাতালগুলোকে এনডোট্র্যাকিল টিউব জীবাণুমুক্ত করে পুনরায় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ টিউবগুলো দিয়ে নবজাতকের ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের একজন সার্জন বলেন, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ এখন খুবই অপ্রতুল। হাসপাতালগুলো বাধ্য হয়ে একটি ক্যাথেটার একাধিকবার ব্যবহার করছে।
বসত বাড়িতে বিদ্যুৎ না দিয়ে সরকার হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরও লোডশেডিং হচ্ছে।
একজন চিকিৎসক সিএনএন- কে বলেন, হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত এক শিশুর অস্ত্রোপচার করার সময় তারা লোডশেডিং-এর মুখে পড়েছিলেন। তখন বাধ্য হয়ে জেনারেটর চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকে মোবাইল ফোনের লাইট দিয়ে অস্ত্রোপচার চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
দুইটি মোবাইল ফোনের আলো থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে অস্ত্রোপচার ও সেলাই করতে বেগ পেতে হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
হাসপাতালে চিকিৎসকদের ক্যাথেটার ও টিউব একাধিকবার ব্যবহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে রোগীদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও আপাতত এর বাইরে কোনও পথ খোলা নেই চিকিৎসকদের সামনে।
চিকিৎসকদের কোন রোগীর জন্য ওষুধ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা ঠিক করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে (আইসিইউ) কতজন রোগী আগামী কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকবেন, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন খোদ চিকিৎসকরা।
ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘যদি এভাবে ওষুধের সঙ্কট চলতে থাকে তবে আগামী কয়েক সপ্তাহে আইসিইউতে থাকা অর্ধেক রোগী বেঁচে থাকবেন কী না, জানিনা।”
ছবি রয়টার্স
যেভাবে এই দশা:
কেউ কেউ বলছেন, এরকম পরিস্থিতি হতে পারে সেটা আগেই সরকারের আঁচ করতে পারা উচিত ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলঙ্কা সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দূরদর্শিতার অভাব এবং কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতে ধস নামার কারণে দেশটির অর্থনীতি এভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে সরকারের কর কমানো এবং অর্থনৈতিক নানা অস্বস্তির কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬৯০ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ এক বছরেই সেটা কমে মাত্র ২২২ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে যায়।
বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ এভাবে কমে যাওয়ায় জ্বালানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি স্থগিত করতে হয়।
দেশটির চিকিৎসাকর্মীরা গত কয়েক মাস ধরেই আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করে আসছিল। সরকারের কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে এমনকি দেশটির ডাক্তার ও নার্সরা রাস্তায় পর্যন্ত নেমেছিলেন।
এতদিন কোনও ধরনের ঘাটতি থাকার কথা উড়িয়ে দিলেও গত বুধবার শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে, দেশে কিছু কিছু ওষুধ এবং অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামে সংকট দেখা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে এক কোটি মার্কিন ডলার পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। তবে ওই অর্থে কেনা ওষুধ কবে-কখন দেশে পৌঁছাবে তা এখনো অজানা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আনভের হামদানি এ পরিস্থিতিকে এখনই সঙ্কট বলতে চান না। তিনি বরং একে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার দাবি এ মাসের শেষ নাগাদ ঘাটতির পেছনের কারণ খুঁজে বের করে সেগুলো সমাধান করে ফেলবে শ্রীলঙ্কার সরকার।
তবে কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, দেশের বর্তমান সঙ্কট মানবসৃষ্ট। গভর্নমেন্ট মেডিকেল অফিসার্স ফোরাম (জিএমওএফ)-এর প্রেসিডেন্ট রুকসান বেল্লানা বলেন, সরকার মজুদের জন্য ক্রেডিট লাইন পরিশোধ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের অনুমোদিত ২৫০০ ফার্মাসিউটিক্যাল আইটেমের মধ্যে ৬০টির সরবরাহ কম রয়েছে। প্রেসিডেন্টে আগেই এজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনও আহ্বান কানে তোলেননি। ফলে অবস্থা দিনকে দিন আরও শোচনীয় হচ্ছে।”
ছবি- সিএনএন
এরপর কী?
শ্রীলঙ্কার সরকারের দাবি অনুযায়ী, তারা অর্থনৈতিক ও চিকিৎসা সঙ্কট দুটোই সমাধান করার চেষ্টা করছে।
এ সপ্তাহে দেওয়া এক বিবৃতিতে দেশটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সাথে চিকিৎসা সামগ্রীর তহবিলের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আলোচনা চালাচ্ছে। এছাড়া, বিদেশে অবস্থান করা শ্রীলঙ্কানদের কাছ থেকে অনুদান পাওয়ারও চেষ্টা করছে।
কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন, জরুরিভিত্তিতে সহায়তার প্রয়োজন।
স্টেট ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে গত ৭ এপ্রিল এ বিষয়ে প্রেসিডেন্টকে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছে। বলেছে, স্বাস্থ্য সঙ্কট সাধারণ জরুরি অবস্থা বলে বিবেচিত হয় না। বরং এটা প্রাণঘাতী সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘‘যদি এখনই জরুরি সরবরাহ পূরণ করা না হয়, তবে হাসপাতালগুলোতে জরুরি চিকিৎসা থমকে যাওয়া কয়েক দিনের ব্যাপার না হলেও কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার তো বটেই। সেটা হলে তা বিপর্যয়কর মৃত্যু ডেকে আনবে।”
স্টেট ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি আমারাসেনা বলেন, সমস্যার সমাধান হওয়ার আগে এটি আরও খারাপের দিকে যাবে। এমনকি বিদেশ থেকে সাহায্য আসতেও কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস লেগে যেতে পারে।
‘‘কিছু কিছু সাপ্লাইয়ার কেবল অর্ডার পাওয়ার পরে ওষুধ তৈরি করে। আর শ্রীলঙ্কায় এখন কোনও স্বাস্থ্যমন্ত্রীও নেই।”
সঙ্কটের কারণে শ্রীলঙ্কার অনেক মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। অনেক পদেই এখন ভারপ্রাপ্তরা দায়িত্ব পালন করছেন। আমারাসেনা বলেন, ‘‘ভারপ্রাপ্তদের হাতে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এদিকে, আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময়ও নেই।‘’
মেয়ের ভালো চিকিৎসার আশায় এ মাসের শুরুতে ক্যান্ডি প্রদেশ থেকে রাজধানী কলম্বোতে এসেছিলেন সেনেবীরত্নে। কিন্তু এখানে এসেও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে।
মন্দার কারণে চাকরির অবস্থাও বেহাল সেনেবীরত্নের। তাই তার পক্ষে বাইরে থেকেও কোনো ওষুধ আনানো সম্ভব নয়।
একই গল্প মিরুর বাবারও। গ্রাম ছেড়ে কলম্বো এসেছিলেন সন্তানের চিকিৎসার জন্য। ওষুধের দোকান থেকে শেষ বোতলটি কিনে নেওয়ার সময় বিক্রেতা তাকে বলে দিয়েছেন, স্টকে থাকা এটাই শেষটা।
আর অল্প কয়দিনের ওষুধ বাকি আছে মিরুর জন্য। তারপর আবার তার বাবাকে চারদিকে ছুটে বেড়াতে হবে ওষুধের খোঁজে।