ক্যাটাগরি

লাভের মৌসুমে লোকসানের হিসাব গুনছেন ‘১০ হাজার’ দোকানি

কিন্তু রোজার মাসের অর্ধেক পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন
বিক্রি সবচেয়ে বেশি জমজমাট হওয়ার কথা, তখন লোকসানের হিসাব কষছেন ঢাকার নিউ মার্কেট
এলাকার বিভিন্ন বিপণি বিতানের দোকানিরা।

সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত এলাকায়
অন্তত ১০ হাজার দোকান রয়েছে বলে হিসাব দিয়েছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।

চাঁদনী চক শপিং মলের বিক্রয়কর্মী নাজিম উদ্দিনের
ভাষায়, “সারা বছর যেমনই যাক, ঈদের মওসুমে ব্যবসাটা করি। এখন ৫০ হাজার থেকে এক লাখ
টাকার মতো বিক্রি হচ্ছে। সেখান থেকে মালিকপক্ষ কিছু নেয়, আমরা স্টাফরা কিছু পাই।

“গত দুই বছর করোনার জন্য মার্কেট বন্ধ ছিল। তখন আমরা
চলছি অনেক ধার দেনা করে। এখন যদি এভাবে মার্কেট বন্ধ থাকে আমরা তো আরও ক্ষতির মুখে
পড়ে যাব।”

নিউ মার্কেট এলাকায় তিন বছর ধরে ফেরি করে ব্যাগ বিক্রি করেন লাল মিয়া হাওলাদার। মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা লোকজনই তার ক্রেতা। মহামারীর ধকল কাটিয়ে সমাগম বাড়তে শুরু করলে বিক্রিও বাড়ছিল। রোজার দিনগুলোতে আসরের নামাজের পর তিনি ঘুরে ঘুরে ব্যগ বিক্রি করছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থী এবং দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের কারণে বিকাল থেকে তাকে মলিন চেহারায় বসে থাকতে হয় ব্যাগ নিয়ে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

নিউ মার্কেট এলাকায় তিন বছর ধরে ফেরি করে ব্যাগ বিক্রি করেন লাল মিয়া হাওলাদার। মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা লোকজনই তার ক্রেতা। মহামারীর ধকল কাটিয়ে সমাগম বাড়তে শুরু করলে বিক্রিও বাড়ছিল। রোজার দিনগুলোতে আসরের নামাজের পর তিনি ঘুরে ঘুরে ব্যগ বিক্রি করছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থী এবং দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের কারণে বিকাল থেকে তাকে মলিন চেহারায় বসে থাকতে হয় ব্যাগ নিয়ে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এই লোকসান গোনার কারণ ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
দোকানকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে ওই এলাকায় অচলাবস্থা।

গত সোমবার রাতে নিউ মার্কেটের একটি খাবার দোকানে ঢাকা
কলেজের কয়েক শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হওয়ার পর ভোররাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
সংঘর্ষ বাঁধে দোকানকর্মীদের।

‘সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে’ নিউ মার্কেটে সংঘাত শুরুর ভিন্ন কারণ
 

এর জের ধরে মঙ্গলবার দিনভর সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে রূপ নেয়
ওই এলাকা। সংঘর্ষে এক পথচারী নিহত হন, আহত হন দোকানকর্মী, শিক্ষার্থীসহ অন্তত অর্ধশত
ব্যক্তি।

এই কারণে সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত
১০টি বড় বিপণি বিতানসহ সব মার্কেট ছিল বন্ধ। সড়কও বন্ধ ছিল। বুধবারও খোলেনি
মার্কেটগুলো। দুই-একটি দোকান খুললেও বিকালে হাতবোমা বিস্ফোরণের পর বন্ধ হয়ে যায়।

সংঘর্ষের ঘটনায় বুধবার সকালে নিউ মার্কেটের প্রধান ফটক বন্ধ থাকলেও ভেতরে অবস্থান নেয় দোকান মালিক ও কর্মচারীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সংঘর্ষের ঘটনায় বুধবার সকালে নিউ মার্কেটের প্রধান ফটক বন্ধ থাকলেও ভেতরে অবস্থান নেয় দোকান মালিক ও কর্মচারীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের কেনাকাটার জনপ্রিয়
স্থান নিউ মার্কেট এলাকার বিপণি বিতানগুলো। পাশাপাশি ফুটপাতের দোকানেও ভিড় জমে
ঈদের আগে। পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী, অলঙ্কারসহ হরেক রকম পণ্য মেলে এসব দোকানে, যা
ঈদের কেনাকাটায় স্থান করে নেয়।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ঈদের মওসুমে এসব দোকানে দৈনিক
৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩/৪ লাখ পর্যন্ত বিক্রি হয়। এখন ভরা মৌসুমে লোকসান
গোনার আশঙ্কায় তারা।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের দোকান মালিক কর্মচারীদের সঙ্গে দিনভর সংঘর্ষের পরদিন বুধবার সকাল থেকে বন্ধ ছিল নিউ মার্কেটের প্রধান ফটক। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের দোকান মালিক কর্মচারীদের সঙ্গে দিনভর সংঘর্ষের পরদিন বুধবার সকাল থেকে বন্ধ ছিল নিউ মার্কেটের প্রধান ফটক। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকা নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি শাহীন
আহমেদ এলাকার ব্যবসার বিস্তৃতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, চন্দ্রিমা মার্কেট, ঢাকা
নিউ সুপার মার্কেট, ঢাকা নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, নূর ম্যানশন, ধানমণ্ডি হকার্স
মার্কেট, বদরুদ্দোজা মার্কেট, গ্লোব মার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, নেহাল ভবন, সায়েন্স
ল্যাব থেকে নিউ মার্কেট এবং গাউছিয়া থেকে বাটা সিগনাল যাওয়ার রাস্তার দুই ধারে ১০
হাজারেরও বেশি দোকান রয়েছে।

এই সংঘাতের ব্যবসায়িক ক্ষয়ক্ষতি কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন,
“এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে ৫৫ হাজারের বেশি মানুষের জীবিকা জড়িত। এখানে
ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব নির্ণয় করা কঠিন।”

সংঘাতের মধ্যে অনেক দোকান অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর এবং লুটপাট
হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

নিউ মার্কেটে ৫৫০টি দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকানকে
কেন্দ্র করে সেখানে অন্তত ৫ জনের কর্মসংস্থান রয়েছে। সিটি করপোরেশনের পরিচালনায় যে
পাঁচটি মার্কেট রয়েছে সেগুলোতে ৫ হাজারের বেশি দোকান রয়েছে।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় বুধবার সকাল থেকেই আশপাশের সব মার্কেট বন্ধ ছিল। দোকান মালিক ও কর্মচারীদের অবশ্য ভেতরে অবস্থান নিতে দেখা যায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় বুধবার সকাল থেকেই আশপাশের সব মার্কেট বন্ধ ছিল। দোকান মালিক ও কর্মচারীদের অবশ্য ভেতরে অবস্থান নিতে দেখা যায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বেচা-বিক্রি কতটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে- জানতে চাইলে শাহিন
বলেন, “একেক দোকানের বেচা-বিক্রি একেক রকম। ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ
টাকা পর্যন্ত। ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি দোকানে গড়ে ৫০ হাজার টাকার বেচাবিক্রি ধরে নিলেও
এখানে একদিনে হিউজ লস হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা করে ধরলে প্রতিদিন গড়ে ৫০ কোটি টাকার
বেচাবিক্রি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “ঈদের আগের ১০/১৫ দিন হচ্ছে সারা বছরের
মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেচা-বিক্রি হয়ে থাকে। গত দুই বছরের কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে এখন
কিছুটা ঘুরে দাড়ানোর মতো পরিস্থিতি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে নতুন এক অস্থিরতা
আমাদের জন্য অনেক ক্ষতি।”

চাঁদনী চক শপিং মলের বিক্রয়কর্মী নাজিম উদ্দিন বলেন, “ঈদ
উপলক্ষে আমরা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাতের ১১টা পর্যন্ত বেচাকেনা করছিলাম। আমাদের
এখন প্রতি সেকেন্ডেই ক্ষতি।”

মঙ্গলবার নিউ মার্কেট এলাকায় সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও ঈদের
আগে তা খোলাই থাকে। ফলে মঙ্গল ও বুধবার মিলিয়ে দুদিন দোকান ছিল বন্ধ।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের দোকান মালিক কর্মচারীদের সঙ্গে দিনভর সংঘর্ষের পরদিন বুধবার সকাল থেকে বন্ধ ছিল নিউ মার্কেটের প্রধান ফটক। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের দোকান মালিক কর্মচারীদের সঙ্গে দিনভর সংঘর্ষের পরদিন বুধবার সকাল থেকে বন্ধ ছিল নিউ মার্কেটের প্রধান ফটক। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ক্ষতির মাত্রা বোঝাতে গিয়ে নাজিম বলেন, “আমার দোকানে
হয়ত ৫০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা বিক্রি হয় প্রতিদিন। কিন্তু অনেক দোকান আছে ২/৩
লাখ টাকাও বিক্রি হয়।”

গাউছিয়া মার্কেটের শো রূম আবরনীর মালিকের কাছে
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

আরেকজন দোকান মালিক বলেন, “এখন আর ক্ষয়ক্ষতির কথা বলে
লাভ নেই। ঝামেলা যতই দীর্ঘ হবে, ক্ষতি ততই বাড়বে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি হচ্ছে,
যেন দ্রুত মার্কেট খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।”

চাঁদনী চক সুপার মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি
নিজাম উদ্দিন বলেন, “চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা শঙ্কিত। কারণ প্রশাসনের প্রচেষ্টার
পরও এই সংঘর্ষ থামছে না। ঈদের মওসুমে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে
যাচ্ছে।”

সংঘর্ষের পর বুধবার সকালে ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশের মার্কেটের সামনে দোকান খোলার অপেক্ষায় মালিক ও কর্মচারীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সংঘর্ষের পর বুধবার সকালে ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশের মার্কেটের সামনে দোকান খোলার অপেক্ষায় মালিক ও কর্মচারীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বুধবার দুপুরে নিউ মার্কেট দোকান সমিতির কার্যালয়ের সংবাদ
সম্মেলনে আসেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।

তিনি বলেন, “আমরা ঘটে যাওয়া সুষ্ঠু তদন্ত চাই এবং দোষীদের
শাস্তি চাই।… অনেক ক্ষতি হয়েছে, এখন থেকেই আমরা দোকানপাট খুলে দিতে চাই।”

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা এই সংঘাতের জন্য
দোকানকর্মীদের দায়ী করে আসছে। ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেনেরও
অভিযোগ, মঙ্গলবার সকালে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে দোকানকর্মীরা চড়াও না হলে
পরিস্থিতির এতটা অবনতি হত না।

এখন দুই পক্ষই চাইছে সঙ্কটের সমাধান। তবে ব্যবসায়ীদের
সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

সংবাদ সম্মেলনে নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির নেতা শাহীন
বলেন, তারাও আলোচনা চান।

“আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং অত্র
এলাকার ব্যবসায়ীসহ আলোচনার মাধ্যমে একটি কোর কমিটি গঠনের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করব,
যাতে করে যে কোনো ঘটনা আলোচনার ভিত্তিতে সুষ্ঠূ সমাধান করতে পারি।”

শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোনো ধরনের উসকানিমূলক কথা না বলার
জন্য নিউ মার্কেট এলাকার দোকান মালিক ও কর্মচারীদের প্রতিও অনুরোধ জানান তিনি।

ব্যস্ত নিউ মার্কেট এলাকায় দিনভর সংঘাত, কার কী দায়?
 

সাদা পতাকা তুললেন নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা