ক্যাটাগরি

‘আমার বাবারে ইট দিয়া বাইড়াইয়া মারল!’

“ও মোরসালিন! ও আমার বাবা! আমি আমার বাবারে আর কই পামু রে! নামাজ পড়তে যাইতাছিল আমার বাবা, গ্যাঞ্জামের মধ্যে ডাইক্কা নিয়া আমার বাবারে ইট দিয়া বাইড়াইয়া মারল!”

নিউ মার্কেট এলাকায় দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ কেড়ে নিয়েছে কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা নূরজাহান বেগমের ছেলে মোহাম্মদ মোরসালিনের প্রাণ।

সোমবার রাতে নিউ মার্কেট এলাকায় দুই দোকানের কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী সংঘাতে গড়ায়। মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সারাদিন দফায় দফায় সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন, তাদের মধ্যে ছিলেন মোরসালিন।

দুই দিন আগে ইটের আঘাতে আহত ২৬ বছর বয়সী এই তরুণকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

ময়নাতদন্ত শেষে মোরসালিনের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার পর দুপুর ২টা নাগাদ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের হাসান নগর এলাকায় তার মামার বাসায় নেওয়া হলে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

শোকে কাতর মোরসালিনের মা নূরজাহান বেগম কিছুতেই ছেলের মৃত্যু মানতে পারছিলেন না। বারবার বলছিলেন, “আমিও মইরা যাইগা আমার বাবার লগে! আমার পাগলা বাবাটা নাই, আমি থাইক্কা কী করুম?

মোরসালিনের বড় মেয়ে হুমায়রাকে ধরে কাঁদছেন স্ত্রী অনি আক্তার মিতু, তার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন মোরসালিনের বোন মিতু। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মোরসালিনের বড় মেয়ে হুমায়রাকে ধরে কাঁদছেন স্ত্রী অনি আক্তার মিতু, তার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন মোরসালিনের বোন মিতু। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

“এত অল্প বয়সী তরতাজা পোলা আমার, মইরা গেল! রোগে-শোকে মরলেও মনরে মানান যাইত। এমন ঘটনা কেমনে মাইনা নিমু আমি, কেমনে সহ্য করুম?”

বড় ছেলে নূর মোহাম্মদের সঙ্গে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় থাকেন নূরজাহান বেগম। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে একই এলাকার পশ্চিম রসূলপুরে ভাড়া বাসায় থাকতেন মোরসালিন।

ছেলের সঙ্গে শেষ দেখার কথা মনে করে নূরজাহান বেগম বলেন, “আমার লগে মোরসালিনের দেখা হইছে প্রথম রোজায়। সে নিজেই আমারে কইল, প্রথম রোজায় সবাই মিল্যা একলগে ইফতার করমু।

“বাবা আমার দুই বোতল জুস নিয়া আইছিল। রাতে খাইয়া যাইতে কইসিলাম। কইল বাসায় গিয়া বউসহ রাইন্ধা খাইব। আমার পোলারে তো আর দেখুম না, আমার লাইগ্যা আরতো কেউ জুস নিয়া আইব না।”

ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, “আমার পোলার তো কোনো দোষ ছিল না। তারে এমনে মাইরা ফেলাইল, এর বিচার আমি চাই।

রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় দোকান কর্মচারী মো. মোরসালিনের মৃত্যুতে স্ত্রী অনি আক্তার মিতুর কান্না থামছিল না, কিছু্ই বুঝে উঠতে পারছে না পাশে থাকা ছোট ছেলে হামজা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় দোকান কর্মচারী মো. মোরসালিনের মৃত্যুতে স্ত্রী অনি আক্তার মিতুর কান্না থামছিল না, কিছু্ই বুঝে উঠতে পারছে না পাশে থাকা ছোট ছেলে হামজা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

“তার ছোট ছোট দুইটা পোলাপান, বউটাও অসুস্থ থাকে, আমি আগে মাইনষের বাড়িতে কাজ কইরা পোলাপান মানুষ করছি। আমার পোলার বাচ্চাগুলারে কে দেখব? তারা কেমনে বড় হইব?”

পাশের রুমেই স্বামীর মৃত্যুর শোকে বিলাপ করছিলেন মোরসালিনের স্ত্রী মিতু আক্তার। তার কোলে ছিল সাত বছরের মেয়ে হোমায়রা এবং চার বছরের ছেলে আমির হামজা। অবুঝ শিশুদুটি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল মায়ের দিকে। তাদের বাবা নেই, সেটি বোঝার মত বয়সও তাদের হয়নি। কান্না আর আহাজারির মধ্যেও একটু পরপর খুঁজছিল তাদের বাবাকে।

মিতু আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা। তারা একটু পরপরই বাবারে খুঁজতেছে। কই থেকে আমি তাদের বাবারে আইনা দিব? আমি আমার স্বামীরে কই পামু? দুইটা বাচ্চারে আমি কেমনে মানুষ করমু?

“আর বিচার চাইমু কার কাছে? বিচার চাইলে কী আমি আমার স্বামীরে ফেরত পামু? সরকারের কাছে আমি বাচ্চাগো ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করা ছাড়া আর কিচ্ছু কইতে পারতেছি না।”

স্বামীর সঙ্গে শেষ কথাগুলো মনে করে মিতু বলেন, “মঙ্গলবার সকালে তার সাথে আমার শেষকথা হয়। সকালবেলা সে বাচ্চা দুইটারে চুমা দিয়ে গেছে। আমারে চুমা দিয়ে গেছে।

“ছেলেটা কইতেছিল, বাবা আজকে তুমি যাইও না। ছেলের কথা শুইন্যাও যদি না বাইর হইত, তাইলে তো এই দিন আর দেখতে হইতো নাগো।”

বিলাপের সুরে মোরসালিনের স্ত্রী বলেন, “বিকাল ৩টা বাজে আমারে মেডিকেল থেকে আমার ভাই ফোন দিছে। দিয়া কইছে আমার স্বামীর অবস্থা ভালো না।

“আমার স্বামী নামাজ পড়তে যাইতেছিল, নামাজ পইড়াই বাড়িতে আসার কথা ছিল। সে আর নামাজও পড়তে যাইতে পারে নাই, বাড়িতেও আইতে পারে নাই। পথেই তারে মাইরা ফেলছে গো।”

মঙ্গলবার দুপুরের দিকে নূরজাহান মার্কেটের সামনে ইটের আঘাতে আহত হন মোরসালিন। পরে তাকে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।  

নিউ সুপার মার্কেটে একটি তৈরি পোশাকের দোকানে কাজ করতেন মোরসালিন। তার বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে, বাবার নাম মো. মানিক মিয়া।

নিউ মার্কেট এলাকার দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় এ নিয়ে দুই জনের মৃত্যু হল। এর আগে নাহিদ মিয়া নামে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ মঙ্গলবার রাতে মারা যান।

 

আরও পড়ুন


নিউ মার্কেটে সংঘর্ষ: মোরসালিনকেও বাঁচানো গেল না
 

নিউ মার্কেটের সংঘর্ষে আহত একজনের মৃত্যু

‘গরিব বইলা কেউ বিচারের কথা কয় না’