কারখানা শ্রমিক মো. নাদিমের বড় ছেলে নাহিদ মিয়া (১৮) ৭ হাজার টাকা বেতনে এলিফ্যান্ট রোডের ডাটা টেক কম্পিউটার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারি অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করতেন।
কামরাঙ্গীরচরের মধ্য রসুলপুরে থাকতেন পরিবারের সঙ্গে।
সরু গলির মধ্যে বাড়িটিতে কেবল ঢোকার মুখে সামান্য একটু দেওয়াল প্লাস্টার করা, তার ওপরে কাঁচা হাতে বাংলা ও ইংরেজিতে ‘নাহিদ’ নামটি লেখা। এছাড়া আধকাঠা জমির উপর কোনরকমে গড়ে তোলা দোতলা এই ভবনটিতে কোনো প্লাস্টার নেই। দরজা-জানলাও ঠিকমতো লাগানো হয়নি। এই ভবনেই কয়েক বছর ধরে বাস করছে নাদিমের পরিবার।
মঙ্গলবার সংঘর্ষের পড়ে প্রাণ হারানোর নাহিদের দাফন শেষ করে বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে থানা ঘুরে বাড়ি ফেরেন তার বাবা নাদিম।
আত্মীয়-স্বজন নারী-পুরুষেরা ঘিরে ধরলেন তাকে। আত্মীয়রা বোঝাচ্ছিলেন- ‘বিচার চাইলেই কী আর পাইবা। ঝামেলায় পড়ার আর দরকার নাই’।
নাদিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওসি সাহেব বলছেন আপনি আসেন, মামলা দিয়া যান। স্যাররা বলছে যে তুমি একটা সাইন দিয়া যাও, ডকুমেন্ট দাও। তুমি তো বাবা, তোমরা তো চাও তার আত্মার শান্তি পাক। খুনিরা শাস্তি পাক। কিন্তু আমার ভেতরে কী জ্বলতাছে, সেইটা না আমি জানি। আমার তো আরও সন্তান আছে, আমিও তো রাস্তাঘাটে চলি। কী করুম আর কন?”
ছেলের বিচারের ভার সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিয়েছেন জানিয়ে নাদিম বলেন, “আমি তো গরিব মানুষ, দিন আনি দিন খাই। কোনো দিন কোর্ট কাচারি যাই নাই। আমি ঝামেলায় যাইবার চাই না। আমি চাচ্ছি যেইটাতে ভালো হয়, সেইটা তারা কইরা দিক। কে মারল না মারল, আমি সব আল্লার উপর ছাইড়া দিছি। হ্যায় চাইলে সুষ্ঠু বিচার হইব।”
“এই দেশের যে প্রধানমন্ত্রী, তার যদি দয়া লাগে আমার পোলাটার জন্য, উনি যদি দ্যাখে… আমরা যদি তাইলে বিচারডা পাই। আমার পোলাডার তো কুনো দোষ ছিল না। হ্যায় তো হ্যার কামে যাইতাছিল,” বলেন তিনি।
নাহিদের মা নার্গিস বেগমও বলেন, “আমরা কার ধারে বিচার চামু, কুনো বিচার লাগত না আমার। এক কতা কইতে কইতে হয়রান আমি।”
নাহিদের বাবা-মা বিচারের আশা না দেখলেও পাশে দাঁড়িয়েই তার স্ত্রী ডালিয়া সুলতানা বিচার চাইছিলেন।
সদ্য স্বামীহারা এই তরুণী বলেন, “আমরা গরীব বইলা কেউ বিচারের কথা কয় না। কিন্তু আমি নায্য বিচার চাই। গরিব বইলা আমাগো বিচার থাকবো না, তা না।
“আইজকা যদি আমার স্বামী কলেজের ছাত্র হইত, মার্কেটের লোক হইত, তারা কিন্তু বইসা থাকত না। তারা ঝামেলা করত, একটা বিচার পাওয়ায় দিত। আইজকা আমরা গরিব বইলা সরকারে বিচার দিবো না, তা না। আমি বিচার চাই, আর আমাগো সংসারের ভরণপোষণও দিতে হইব।”
ব্যস্ত নিউ মার্কেট এলাকায় দিনভর সংঘাত, কার কী দায়?
নিউ মার্কেটের সংঘর্ষে আহত একজনের মৃত্যু
শৈশব থেকেই খেটে চলেছেন
নাহিদ হাসানের বাবা মো. নাদিম।
স্ত্রীর সূত্রে পাওয়া আধকাঠা জায়গার উপর কোনো রকমে যে বাড়িটি বানিয়েছেন নাদিম, তাতে পরিবারটির অনেক ঋণ করতে হয়েছে। তিনি কাজ করে যে কয় টাকা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চালান, আর নাহিদের টাকায় ঋণ শোধ হয়। বাড়ির ঋণ শোধ হয়ে গেলেই পরিবারটি ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল।
নাদিম বলেন, “আমি আর ছেলে দুজন মিল্যা কর্ম কইরা সংসার চালাই। ছেলে আমার ঋণ শোধ করত।”
নাদিমের তিন ছেলের মধ্যে নাহিদ বড়। বাকি দুই ছেলের মধ্যে একজন সাত বছরের, আরেকটির বয়স মোটে তিন বছর।
ম্যাটাডোর প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক নাদিম জানান, অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা হয়নি নাহিদের। এরপর থেকেই কাজে লেগে যান।
“২০০৩ সালে ওর জন্ম। এখনো ১৯ বছর পুরে নাই ওর। সেই ছোট বেলা থিকাই কাম করতাছে। পোলাডা আমার সুখের মুখ দেখল না। পাঁচ ক্লাস পড়াইতে পারছি। গরিব মানুষ তো, পাঁচ ক্লাস পইড়াই মার্কেটে কাম নিছে। কাপড়ের দোকানে কাম করছে, দারোয়ানের কাম করছে, কুরিয়ার সার্ভিসে করছে। যখন যেখানে পাইছে সেইখানে করছে। সংসারটা তো টাইনা নিতে হইব…”
ঢাকার বুকে ‘বাড়িওয়ালা’ তকমা পেলেও পরিবারটির আর্থিক দুরবস্থা বোঝা যায় ভেতরে ঢুকলে। ওপর-নিচ তলা মিলে মোটে দুটো ঘর। আর নাহিদ তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলার ছাদে বাঁশ-টিনের ঘর বানিয়ে থাকতেন। সেখানে তেমন কোনো আসবাব নেই। সেই ঘরেরই বাঁশের বেড়া, গান শোনার যন্ত্র, রশিতে ঝোলানো কাপড়ে স্বামীকে খুঁজছেন ডালিয়া।
কষ্টের জীবন, বেঘোরে শেষ
নাহিদ হাসানের স্ত্রী ও মা।
নিজেদের শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে স্ত্রী ডালিয়া সুলতানা বলেন, এর আগে কয়েকদিন কাজে যাননি নাহিদ। মঙ্গলবার সকালে স্ত্রীকে বলেন, ‘কয়েকদিন অ্যাবসেন্ট হইছে, ঈদের আগে আর অ্যাবসেন্ট করুম না।’ এরপর তার সুপারভাইজারকে ফোন দেন তিনি। সুপারভাইজার যেতে বলেন।
পয়সা বাঁচাতে কামরাঙ্গীরচর থেকে নিউ মার্কেট এলাকা হয়ে এলিফ্যান্ট রোডের কর্মস্থলে হেঁটেই যাতায়াত করতেন নাহিদ। প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যেতে।
ডালিয়া বলেন, “সেদিন ১০টার পরেই বাসা থেকে বের হন। এরপর তিনি নিউ মার্কেট এলাকায় গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে যান।”
স্বামীর আহত হওয়ার খবর শুনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে নাহিদকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পেয়েছিলেন ডালিয়া।
“ওরে এমনভাবে কোপাইছে। সারা শরীরে মাংস জায়গায় জায়গায় বাইরায়া গ্যাছে। শইরে কুনো রক্ত আছিল না।”
নাহিদের মৃত্যুর পর পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার মাথার বাম পাশে পাশাপাশি চারটি কাটা জখম। এই জখমগুলো দুই থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা। চারটি জখমে ২৩টি সেলাই দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। পিঠের বাম পাশে পাশাপাশি তিনটি কাটা জখম। যার প্রত্যেকটি পাঁচ ইঞ্চি করে লম্বা। বাম পায়ের গোড়ালির নিচে কাটা জখমেও পাঁচটি সেলাই লেগেছে, এছাড়া উভয় পায়ের বিভিন্ন জায়গায় নীল-ফোলা কালা জখম রয়েছে। নাক, মুখের ছোলা জখম রয়েছে।
এ ঘটনায় বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত মামলা হওয়ার কথা জানায়নি নিউ মার্কেট থানা পুলিশ।