রক্তক্ষয়ী সংঘাতে দুদিন নিউ মার্কেট এলাকায় অচলাবস্থার পর বুধবার রাতে
যখন সমঝোতা বৈঠকের তোড়জোড় চলছিল, তখন রাত ৯টার পর তিনটি মামলা হয়। এর একটিতেই আসামির
তালিকায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সেই মামলাটিতে ১ নম্বরে রয়েছে আইনজীবী মকবুলের
নাম।
নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল দাবি করছেন, সরকারবিরোধী
রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাকে মামলার আসামি করা হয়েছে।
তবে সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা মহানগর পুলিশের নিউ মার্কেট জোনের
অতিরিক্ত কমিশনার শাহেন শাহ বলছেন, দলীয় পরিচয় দেখে নয়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আসামি
করেছেন তারা।
নিউ মার্কেট থানায় দায়ের করা তিনটি মামলার মধ্যে দুটি করেছে পুলিশ। একটি
করেছেন সংঘর্ষে প্রাণ হারানো নাহিদ হাসানের চাচা মো. সাঈদ। হত্যার অভিযোগে করা এই
মামলায় আসামির তালিকায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
সংঘর্ষের সময় হাতবোমা ফাটানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরক আইনে মামলাটি
করেছেন নিউ মার্কেট থানার এসআই
মেহেদী হাসান। এতে আসামি হিসেবে ১৫০ থেকে ২০০ জনের কথা বলা হলেও সবাই অজ্ঞাতনামা।
দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশের কাজের বাধা দেওয়ার অভিযোগে
নিউ মার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির যে মামলা করেছেন, তাতেই শুধু আসামির
তালিকায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। আর অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে ২০০ থেকে ৩০০ জন ব্যবসায়ী
ও দোকানকর্মী এবং ৬০০-৭০০ কলেজ শিক্ষার্থীর কথা বলা হয়েছে এজাহারে।
২৪ জন আসামির মধ্যে মকবুল ছাড়াও রয়েছেন- আমির হোসেন আলমগীর, মিজান, টিপু
হাজি জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, হাসান জাহাঙ্গীর মিঠু, হারুন হাওলাদার, শাহ আলম শন্টু,
শহিদুল ইসলাম শহিদ, জাপানি ফারুক, মিজান বেপারী, আসিফ, রহমত, সুমন, জসিম, বিল্লাল,
হারুন, তোহা, মনির, বাচ্চু, জুলহাস, মিঠু, মিন্টু ও বাবুল।
মকবুল ছাড়া অন্য কারও ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় জানা যায়নি।
আসামিদের বিষয়ে জানতে চাইলে নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান
আমিনুল ইসলাম শাহিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নামগুলো
সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। মকবুল হোসেন ছাড়া আর কাউকে চিনি না।”
মকবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, “বিএনপি
করি বলেই আমি আসামি।”
তিনি জানান, বর্তমানে বিএনপির নিউ মার্কেট থানা কমিটি নেই। আগের কমিটির
সভাপতি ছিলেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিউ মার্কেটের দুটি খাবার দোকানের মালিক
মকবুল। ফাস্ট ফুডের এই দোকান দুটি হল ‘ক্যাপিটাল’ ও ‘ওয়েলকাম’। তবে
কোনো দোকানই নিজে চালান না। রফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজনকে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন
দোকান দুটি। রফিকুল ও শহিদুল আবার পরস্পরের আত্মীয়।
পুলিশের করা মামলায় আসামির তালিকায় শহিদুল ইসলাম নামটি থাকলেও সেটা ‘ওয়েলকাম’ ভাড়া
নেওয়া শহিদুল কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের সময় নুরজাহান সুপার মার্কেটের নিচ তলার দোকানে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় দোকানের কর্মীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
অ্যাডভোকেট মকবুল বলেন, “গত ছয়
মাস হল আমি নিউ মার্কেট এলাকায় যাই না। ধানমণ্ডির বাসা থেকে উচ্চ আদালতে যাই, সেখান
থেকে পল্টনে চেম্বারে যাই।
“১৫ বছর ধরে ওই দুটি দোকান রফিকুল ও শহিদুলকে ভাড়া
দেওয়া। আর এখন তাদের দুই কর্মচারীর মারামারিতে আমি আসামি!”
আসামি করা নিয়ে মকবুলের অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা শাহেন শাহ বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে কে কোন দলের, তা
বিষয়বস্তু নয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই নাম এসেছে।”
এজাহারে ২৪ জনের নাম উল্লেখের বিষয়ে নিউ মার্কেট থানার ওসি স ম কাইয়ুম
বলেন, “যাদের নাম এসেছে, উসকানিদাতা
হিসেবে এসেছে।”
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউ মার্কেটের দোকানকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের
সূত্রপাত হয়েছিল গত সোমবার রাতে, ‘ক্যাপিটাল
হোস্টেলে’ ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র মারধরের
শিকার হওয়ার পর।
দোকান মালিকরা জানান, দুই দোকানের কর্মীদের বচসা থেকে এক পক্ষ ঢাকা কলেজ
ছাত্রলীগের কয়েক কর্মীকে ডেকে আনে। তারা ক্যাপিটালে গিয়ে সেখানকার দোকানকর্মীদের
মারধরের শিকার হয়। এরপর তারা কলেজ হোস্টেলে ফিরে দলে ভারী হয়ে গিয়ে ওই দোকানটি ভাংচুর
করে।
মঙ্গলবার প্রথম প্রহর থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলার পর পুলিশ
থামিয়েছিল। কিন্তু সকালে বাধে ব্যাপক সংঘর্ষ, তাতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ওই এলাকার বিপণি বিতানগুলোর দোকানকর্মীদের পাশপাশি হকাররা।
মঙ্গলবার দিনভর চলা সংঘর্ষের কারণে সেখানে কোনো দোকান খোলেনি, মিরপুর
সড়কও ছিল বন্ধ। সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে নাহিদ হাসান নামে একজন ডেলিভারিম্যান সেদিনই মারা
যান, মোরসালিন নামে এক দোকানকর্মীর মৃত্যু হয় বৃহস্পতিবার।
মঙ্গলবারের পর উত্তেজনা চলায় ঈদের বাজারে বুধবারও সব বিপণি বিতানের দোকান
ছিল বন্ধ। ঢাকা কলেজ বন্ধ ঘোষণা করলেও ছাত্ররা কলেজে অবস্থান নিয়ে ছিল।
এরপর বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও পুলিশের মধ্যস্থতায়
বৈঠকে সমঝোতা হওয়ার পর সকালে সব দোকান খোলে।
বৈঠকে সমঝোতা, খুলছে নিউ মার্কেট
নিউ মার্কেটে সংঘর্ষ: তিন মামলায় আসামি সহস্রাধিক
নিউ মার্কেটে সংঘর্ষ: ৩ মামলা তদন্তে পুলিশকে দেড় মাস সময়
যে দুইটি খাবারের দোকানের দ্বন্দ্ব থেকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের সূত্রপাত, তার একটি ক্যাপিটাল ফাস্ট ফুড বন্ধ দেখা গেছে বৃহস্পতিবার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
সংঘাতের শুরু ইফতারির টেবিল নিয়ে
নিউ মার্কেটের ৪ নম্বর ফটক সংলগ্ন দোকানেই সোমবার রাতে ঝামেলা শুরু হয়েছিল।
সেখানকার দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দোকানের সামনে ইফতারির টেবিল বসানো নিয়ে
ক্যাপিটাল ও ওয়েলকামের কর্মীদের বচসা থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত।
নিউ মার্কেটে ৫৫০টি দোকান রয়েছেন বলে জানিয়েছেন মার্কেটের ব্যবসায়ী
সমিতির সভাপতি শাহিন। এর মধ্যে ৩৮টি খাবারের দোকান। এগুলো মার্কেটের চারটি ফটকের প্রবেশমুখে।
চার নম্বর ফটকে রয়েছে প্যানজী জুস কর্নার, ওয়েলকাম, ক্যাপিটাল, ফুডপার্ক,
চাপড়ি ফাস্ট, আল আমিন ফুড, আরোমা, কিংস, ওয়েস্টার্ন ফুড ইত্যাদি দোকান।
খোলামেলা নিউ মার্কেটে ফাস্টফুডের ওই দোকানগুলো রমজান মাসে খোলা জায়গায়
বসায় ইফতারির টেবিল।
চার নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকলে প্রথমে প্যানজী জুস কর্নার, তারপর ওয়েলকাম,
তারপর ফুডপার্ক, তারপর দোকানের সামনের রাস্তা আর রাস্তার বিপরীত পাশে ক্যাপিটাল। অর্থাৎ
ওয়েলকাম আর ক্যাপিটাল মার্কেটের ভেতরের সড়কের বিপরীত পাশে।
দুই দোকানের কর্মীদের ঝগড়ার বিষয়ে প্যানজী দোকানের কর্মচারী মো. আরিফ
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সন্ধ্যায় ওয়েলকাম দোকানের কর্মচারী বাপ্পীর সঙ্গে
ক্যাপিটালের কর্মচারী কাওসারের ঝগড়া হয় খোলা জায়গায় ইফতারির টেবিল বসানো নিয়ে। ওই
সময় কাওসার ও তার সঙ্গীরা বাপ্পীকে মারধর করে।
“সন্ধ্যার ঘটনা নিয়ে বাপ্পীর দোকানে রাতে সালিশও
হচ্ছিল। কিন্তু বাপ্পী বের হয়ে ফোন করে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের নিয়ে এসে হামলা করে।”
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরিফ বলেন, “প্রথম
দফায় যারা (ছাত্র) এসেছিল, তারা মার খেয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় এসে সব দোকানে ভাংচুর
চালায়।”
নিউ মার্কেটে রয়েছে এমন ৩৮টি খাবারের দোকান, তার দুটির কর্মীদের মধ্যে বচসায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ার পর রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নিয়েছিল।
প্যানজী দোকান চার নম্বর ফটকের শুরুতে হওয়ায় হামলায় তাদের দোকানের
কাচসহ অনেক কিছু ভাঙচুর হয় বলে তিনি জানান।
প্যানজীর মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, একই মালিকের দুই দোকান চালানো ওয়েলকামের
রফিকুল ইসলাম আর ক্যাপিটালের শহিদুল ইসলাম দুজন চাচাত ভাই।
“তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। অথচ ঝগড়া বাধালো তাদের
দুই কর্মচারী।”
সেই দিনের ঘটনা দূর থেকে দেখা আরেক দোকানের মালিক ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ
আলী বলেন, “আমি চিৎকার করে বার বার বলেছি,
এই রে থাম, বেশি বাড়াবাড়ি কিন্তু ভালা না। কিন্তু কে কার কথা শোনে।”
নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ স্বপন বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অন্য সব দোকান খুললেও ঘটনার তদন্তে ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল
দুটি দোকানই এখন বন্ধ রাখতে বলেছেন তারা।
প্যানজীর মালিক নজরুল বলেন, গত তিন দিনে মালামাল নষ্ট ও গ্লাস ভাঙচুর
নিয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে তার।
গত দুই দিন বন্ধ থাকায় খাবারের দোকানগুলোতে অনেক খাবার নষ্ট হতে দেখা
গেছে।
ব্যস্ত নিউ মার্কেট এলাকায় দিনভর সংঘাত, কার কী দায়?
‘সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে’ নিউ মার্কেটে সংঘাত শুরুর ভিন্ন কারণ