এ সঙ্কট সামাল দিয়ে ডলারের দামে অস্থিরতা ঠেকাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক পদক্ষেপেও নাগালে আসছে না দাম।
আন্তঃব্যাংক লেনদেনে টাকার বিপরীতে ডলারের দর যেমন বেড়েই চলেছে, খোলাবাজারেও তা থেমে নেই। ব্যাংক কিংবা মুদ্রাবাজার থেকে নগদ ডলার কিনতে এখন গুনতে হচ্ছে ৯২ টাকার মতো।
ধারাবাহিকভাবে ডলারের দাম বেড়ে চলার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমদানিতে, বাড়ছে পণ্যের ব্যয়। বিদেশ যেতে যাদের নগদ ডলারের প্রয়োজন তাদেরও গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
আর টাকার অবমূল্যায়নে রপ্তানি আয়ে লাভবান হওয়ার প্রচলিত ধারণার বিপরীতে রপ্তানিকারকরা বলছেন, তারাও ‘ক্ষতির’ মুখে পড়ছেন।
ফাইল ছবি
সরবরাহ সঙ্কটে ডলার কিনতে ব্যাংকগুলো এখন নিয়মিত ধরনা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও পরিস্থিতি বিবেচনায় ডলার বিক্রি করে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিলাসপণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ আরও কিছু নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপও নিয়েছে গত কয়েকদিনে। এরপরও দাম যেন নাগালের বাইরেই রয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। গত ১ মার্চ যা ছিল ৮৬ টাকা। এক বছর আগে ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল এ দর ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক দশমিক ৬৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।
অন্যদিকে আমদানির জন্য ডলারের বিপরীতে গত জানুয়ারিতে জনতা ব্যাংক ৮৫ টাকা ৮৫ পয়সা দর ধরলেও বর্তমানে এ হার ৮৬ টাকা ২৫ পয়সা। এক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৫০ শতাংশ।
তবে সবচেয়ে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে নগদ ডলার কিনতে গিয়ে। নগদ ডলারের দর গিয়ে ঠেকেছে ৯২ টাকায়। ব্যাংক থেকে কিনতে এরসঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাংকভেদে একেক রকম চার্জ।
বুধবার রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ও বেসরকারি সিটি ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৯২ টাকায়। রাজধানীর ভয়েজার মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রনি জানান, এদিন তারা ৯১ টাকা ৪০ পয়সায় ডলার কিনেছেন এবং ৯১ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি করেছেন।
দুদিন আগে সোমবার খোলা বাজারের ডলার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আরজুও একই দরে ডলার কেনাবেচার তথ্য দেন।
দাম বাড়ছে কেন
ব্যাংকাররা বলছেন, কোভিড মহামারী পরবর্তী আমদানি বাড়তে থাকার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ডলার ব্যয় হচ্ছে। এতে সরবরাহে টান পড়ায় দাম বাড়তে থাকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে।
এর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ ও শিক্ষা ব্যয়ের জন্যও ডলারের চাহিদা বেড়েছে বলে তাদের পর্যবেক্ষণ। সবমিলিয়ে এসবের প্রভাব দেখা যাচ্ছে মুদ্রাবাজারে।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, দেশে ডলারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেলেও যোগান সেভাবে বাড়েনি। তাই দাম বেড়ে গেছে।
“আমাদের দেশে আমদানি চাহিদা বাড়ছে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ছে।
“এছাড়া রপ্তানিকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য আমদানির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। আর ডলারের চাহিদা বাড়লেই রেট বাড়বে। দাম তো চাহিদা ও যোগানের ব্যাপার। ডলারের চাহিদা কমলে দাম কমে যাবে।”
ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার অন্য উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে শিক্ষার জন্য টাকা বাইরে পাঠানো, বিদেশ ভ্রমণ ও পর্যটনের কথা উল্লেখ করেন এ ব্যাংকার।
আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণেই ডলার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ আমদানির উপর নির্ভরশীল দেশ। রপ্তানি করতেও আমাদের আমদানি করতে হয়। ভোগ্যপণ্যের জন্যও আমদানি করতে হয়। এসব কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নেগেটিভ। মানে ডলারের ইনফ্লোর তুলনায় আউটফ্লো বেশি।”
তিনি ব্যাংলাদেশ ব্যাংককে ‘আমদানি নিয়ন্ত্রণের’ পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শও দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হয়েছে ৮৩২ দশমিক ৪৮ কোটি ডলার, যা এক বছর আগের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৪৯ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।
তবে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে রপ্তানি বাড়লেও তা আমদানি ব্যয়ের মোট অঙ্কের চেয়ে অনেক কম। অন্যদিকে রেমিটেন্সেও আসাতেও কিছুটা ভাটা দেখা গেছে।
গত মার্চে রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৪৭৬ দশমিক ২২ কোটি ডলারের পণ্য। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এর পরিমাণ ৫৪ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে মার্চে রেমিটেন্স এসেছে ১৮৬ কোটি ডলার, যা এক বছর আগের তুলনায় ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম।
বৈদেশিক মুদ্রা আসার এ দুই প্রধান খাতের চেয়ে আমদানি ব্যয় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাওয়া রিজার্ভও কয়েক মাসের ব্যবধানে কমে মার্চে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
রপ্তানিকারকদের অস্বস্তি
ডলারের চড়া দামে শুধু আমদানি খাতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে তা নয়, রপ্তানিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
সব মিলিয়ে ডলারের বাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতা প্রায় সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।
ব্যাংকে ডলারের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে ক্রয় মূল্যের পার্থক্য বেড়ে যাওয়ার কারণেও ক্ষতির মুখে পড়ার দাবি করেছেন তারা।
দেশের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাকের ৭০ শতাংশ আমদানি করা কাঁচামাল নির্ভর। রপ্তানিতে যতটুকু ভ্যালু এডিশন বা মূল্য সংযোজন হয় তার অধিকাংশই শ্রমিকের বেতন ও পরিচালন ব্যয়।
এ পরিস্থিতিতে ৯০ টাকা সমমূল্যের ডলারে পণ্য আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে রপ্তানি আয়ের বেলায় ডলারপ্রতি ৮৫ টাকা পাওয়ায় রপ্তানিকারকরা বড় ধরনের লোকসানে পড়ছেন বলে জানিয়েছেন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সিনিয়র সহ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সবাই মনে করে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকদের সুবিধা হবে। বাস্তবে কিন্তু তা নয়।
“আমরা কিন্তু রপ্তানি করে ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা কিংবা ৮৫ টাকা ০৫ পয়সা করে পাচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক ৮৬ টাকা ২০ পয়সা ধরেছে ডলারের রেট। কিন্তু সেটাও আমরা পাচ্ছি না।“
দেশের আমদানি-রপ্তানির কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর। ফাইল ছবি
আগের সপ্তাহের তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “গত সপ্তাহে আমি খবর নিয়েছি ব্যাংকগুলোতে। আমরা যখন ব্যাংকে একটা এক্সপোর্ট ডকুমেন্ট জমা দিই তখন (একটি) ব্যাংক থেকে ৮৫ টাকা ১২ পয়সা দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য ব্যাংকে ৮৫ টাকা ০৫ পয়সা করে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি যারা বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তারাও সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ২৫ পয়সা; (ওই) ব্যাংকে তা ৮৫ টাকা ৩০ পয়সা।
“তাহলে ৯১ টাকা থেকে ৯২ টাকা ডলারের রেট হয়ে কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্ত:মুদ্রাবাজার দর অনুযায়ী যেটা ৮৬ টাকা ২০ পয়সা, তাতে আমাদের কী লাভ হচ্ছে?”
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, “ব্যাংক আমাদেরকে দিচ্ছে ৮৫ দশমিক ৭০ টাকা। আর আমদানি করার সময় ৮৯ টাকা থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত ডলারের রেট ধরছে। এখানে স্প্রেড মানি ৪/৫ টাকা করেছে, যেটা ২ টাকা হলেও চলে।“
এ সময়ে ব্যাংকের এত লাভ করা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এমনিতেই প্রডাকশন কস্ট অনেক বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের জন্য অনেক অসুবিধা। গ্যাসের প্রেসার নেই। পণ্যের দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো এ লাভটা করে নিচ্ছে।“
যা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক
চাহিদার কারণে দাম বেড়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরবরাহ বাড়াতে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত (২০ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৬ কোটি ৭ লাখ ডলার খোলা বাজারে বিক্রি করেছে।”
একই সঙ্গে বিলাসবহুল পণ্য আমদানিকে কিছুটা নিরুত্সাহিত করতে নেওয়া পদক্ষেপসহ আরও কিছু উদ্যোগের কথা জানান তিনি।
গত ১১ এপ্রিল এক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে। আগে এ হার ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ঠিক করত।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, “এই নিয়মের ফলে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর ডলারের চাহিদাও কমানো যাবে।”
পাশাপাশি ডলারের সরবরাহ বাড়াতে ‘ডলার বন্ডে’ সীমাহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের জন্য চালু থাকা এ বন্ডের সুদের হারও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এতে সুদ আকারে ডলার দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া যেমন কমে যাবে। আবার এ বন্ডে বিনিয়োগ বাড়লে ডলার দেশেও ঢুকবে।