বিবিসি জানায়, গত কয়েক দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই গ্রাফিক ভিডিওগুলো পোস্ট করা হয়।
এর আগে রাজধানী কিইভের কাছের বুচা শহরে রাস্তায় বেসামরিক নাগরিকদের লাশ পড়ে থাকার ছবি বিশ্বজুড়ে তোলপাড় তুলেছিল।
ইউক্রেইনের আগ্র্রাসনের সময় রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে শত শত বেসামরিক নাগরিকে হত্যার যে অভিযোগ উঠেছে তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের ওই তদন্ত এখনো চলছে। এর মধ্যেই মারিউপোলের কাছে প্রায় ৮৫ মিটার দীর্ঘ গণকবরের সন্ধান মিলেছে বলে প্রথমে খবর বের হয়। স্যাটেলাইট চিত্রে চিহ্নিত হওয়া এই গণকবরে প্রায় ২০০ মানুষেকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।।
এখন যোগ হয়েছে মারিউপোলের লাশের ভিডিও।
ইউক্রেইনের দক্ষিণের নগরী মারিউপোলে কয়েক সপ্তাহ ধরে তুমুল লড়াই চলছে। নগরীর বেশিরভাগটাই রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে মারিউপোলের পতন ঘটবে।
মারিউপোলের যে ভিডিও পাওয়া গেছে বিবিসি সেটা পার্যালোচনা করে দেখার চেষ্টা করেছে।
ভিডিওতে কী দেখা গেছে?
মারিউপোলে একটি সড়কের একটি সেকশনে মৃতদেহ পড়ে থাকার চারটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে।
বিবিসি জানায়, একটি ভিডিওতে ১৮টি মৃতদেহ দেখা গেছে। পোশাক দেখে যাদের সবাইকেই বেসামরিক নাগরিক মনে হয়েছে। ভিডিওতে কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি।
একটি মৃতদেহ একটি বাস স্টপে পড়েছিল, পাশেই এক ব্যাগ বাজার পড়েছিল। ভাঙা একটি গাড়ির পাশে আরেকটি মৃতদেহ দেখা গেছে।
বিবিসি জানায়, চারটি ভিডিওতে মোট ২৩টি মৃতদেহ দেখা গেছে।
এছাড়া, ওইসব ভিডিওতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবন, ছেঁড়া বিদ্যুতের তার এবং রাস্তায় ধ্বংসস্তুপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। লোকজনকে মৃতদেহের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেও দেখা গেছে।
ভিডিওটি কোথায় ধারণ করা হয়েছে?
সব ভিডিওগুলো মারিউপোলের উত্তরের ইচিল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্কস এর কাছের একটি সড়কের। ভিডিওতে যে সড়কের কথা বলা হয়েছে তার সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে বিবিসি। মৃতদেহগুরো ইলিচ আয়রন প্ল্যান্টের কাছের সড়ক বোইকা এভিনিউতে পড়েছিল।
ভিডিওতে যেসব ভবন, সড়ক চিহ্ন, বাস স্টপেজ এবং অন্যান্য জিনিস দেখা গেছে বিবিসি সেগুলোকে ক্লু হিসেবে বিবেচনা করে ভূউপগ্রহ এবং সড়কের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে।
কে বা কারা ভিডিওগুলো করেছে?
বিবিসি জানায়, একটি ভিডিও করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা প্যাট্রিক ল্যানচেস্টার। তিনি ২০১৪ সাল থেকে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্টে পূর্ব ইউক্রেইনে রাশিয়া ও তাদের মিত্রদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে নিয়মিত ভিডিও আপলোড করছেন।
ল্যানচেস্টার মাঝেমধ্যেই রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন। তাকে ইনফোওয়ার্স ওয়েবসাইটেও দেখা যায়।
আরেকটি ভিডিও পোস্ট করেছেন ইতালির সংবাদিক ভিত্তোরিও নিকোলা রানগেলোনি। তিনি পূর্ব ইউক্রেইনের দনবাস অঞ্চলে বসবাস করেন। তিনি গত মার্চ থেকে মারিউপোলের ভিডিও তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্টে পোস্ট করা শুরু করেছেন।
তৃতীয় এবং চতুর্থ ভিডিওটি রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা আন্না নিউজ এবং ক্রেমলিনপন্থি টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘সিগন্যাল’ থেকে পোস্ট করা হয়েছে।
বিবিসি ল্যানচেস্টার এবং রানগোলেনি উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের দিক থেকে এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।
কখন ভিডিও ধারণ করা হয়েছে?
ভিডিওগুলো কখন ধারণ করা হয়েছে বিবিসি তা নিশ্চিত হতে পারেনি। বিবিসি অনলাইনে প্রথম যে ভিডিওটি পেয়েছে সেটি আন্না নিউজ রিপোর্ট। গত ১৫ এপ্রিল সেটি আপলোড করা হয়।
বাকি দুইটি ভিডিও খুব সম্ভবত ১৮ এপ্রিল এবং ১৯ এপ্রিল পোস্ট করা হয়েছে।
ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভিডিওগুলো যে এলাকায় ধারণ করা হয়েছে সেটি ২৮ মার্চ পর্যন্ত ইউক্রেইনীয় সেনাবাহিনীর দখলে ছিল। গত ৭ এপ্রিল রুশ বাহিনী ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, গত ১৩ এপ্রিল ইউক্রেইনের কয়েকশ সেনা ইলিচ আয়রন প্ল্যান্টে আত্মসমর্পণ করে।
বিবিসি যুক্তরাষ্ট্রের ফার্ম ম্যাক্সার এর কাছে গত মার্চ থেকে বোইকা এভিনিউর স্যাটেলাইট ইমেজ চায়। তারা ১১ এপ্রিল থেকে ছবি পাঠিয়েছে। সেখানে সড়কে মৃতদেহ পড়ে আছে কিনা সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
কীভাবে ওই মানুষগুলোর মৃত্যু হলো?
ভিডিওতে কয়েকজন পথচারীর কাছে পড়ে থাকা মানুষগুলোর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তারা বলেন, ইউক্রেইনের একজন স্নাইপার তাদের হত্যা করেছে। ওই স্নাইপার এই সড়ক দিয়ে চলাচল করা লোকজনকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে।
রানগেলোনির পোস্ট করা ভিডিওতে এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘আমি আতঙ্কে আছি, আমি আতঙ্কিত। তারা বলেছে একজন স্নাইপার সেখানে বসে আছেন, যেসব লোকজন তাদের কাজের নথিপত্র আনতে যাচ্ছে এবং সে তাদের গুলি করছে।”
আরো একজনও একই রকম কথা বলেন। তবে তাদের কেউই নিজ চোখে কোনো হত্যাকাণ্ড দেখেনি বলেও স্বীকার করেছেন।
বিবিসি স্বাধীনভাবে পথচারীদের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। তারা এ বিষয়ে জানতে ইউক্রেইন ও রাশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
ল্যানচেস্টারের ভিডিওতেও এক ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে ইউক্রেইন সরকারের নিন্দা করেন এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রশংসা করেন।
ভিডিওতে যারা কথা বলেছেন বিবিসি কম্পিউটার অ্যালগোরিদম ব্যবহার করে তাদের মুখ যুদ্ধের সময় তোলা অন্য কোনো ছবি বা ভিডিওতে থাকা মুখের সঙ্গে মেলে কিনা তা খুঁজে দেখেছে। কিন্তু লাখ লাখ ছবির মধ্যেও তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মৃতদেহগুলোর শরীরি ভাষা কী প্রমাণ দিচ্ছে?
বিবিসি ভিডিওগুলো সেনাবাহিনীর একজন সাবেক স্নাইপারকে দেখিয়েছেন। যিনি তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
তিনি বলেন, ‘‘স্নাইপারের গুলিতে যে ধরনের আঘাত তৈরি হয় এই আঘাত তেমন নয়।”
একটি মৃতদেহ দেখিয়ে তিনি আরো বলেন, তিনি আশা করেছিলেন মাথায় গুলি লাগার পর সেটি থেকে আরো বেশি রক্তপাত হয়ে তা চারপাশে গড়িয়ে পড়তে দেখা যাবে। ওই মৃতদেহটি দেখে মনে হচ্ছে সেটির চোখে আঘাত লেগেছে।
বিবিসি কয়েকজন ফরেনসিক প্যাথলোজিস্টের সঙ্গেও কথা বলেছে।
তাদের এজন ডা. ভিক্টোর উইডন। তিনি বলেন, ‘‘ইলিচ আয়রন প্ল্যান্টের কাছের সড়কে যেসব মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল তারা সবাই প্রায় একই সময়ে মারা গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
‘‘ছবিগুলোতে মৃতদেহের শরীরে কাপড় রয়েছে। এত দূর থেকে মৃত্যু কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলাও সম্ভব না। তবে খুব সম্ভবত তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, হতে পারে মাথায় গুলি করে।”
আরেক ফরেনসিক প্যাথলোজিস্ট ডা. কার্ল উইগরেনও প্রায় একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘খুব কাছাকাছি সময়ে ওই ব্যক্তিদের মৃত্যু হয়েছে। তবে তারপরও বলবো, তাদের মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না।”
তিনিও মৃতদেহগুলোর চারপাশে খুব একটা রক্ত পড়ে না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
‘‘পুরো পোশাক পরা মৃতদেহগুলিতে দৃশ্যমান আঘাত খুব একটা দেখতে পাচ্ছি না। তাতে আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে, খুব সম্ভবত এগুলো ভোঁতা কোনো শক্তির আঘাতের ফলাফল। বিস্ফোরণ থেকে শক ওয়েভের কারণে সৃষ্ট।”
একটি মৃতদেহ দেখিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘‘এটির মুখমণ্ডলে পচন ধরেছে। মনে হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ ধরে মৃতদেহটি সেখানে পড়ে আছে। মুখমণ্ডলে মাংস নেই, হয়তো কোনো প্রাণী তা খেয়ে ফেলেছে।”