তবে এ প্রকল্পের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার অংশের কাজ এগিয়ে চলছে। আর ঘুমধুম অংশের অর্থ অন্য কোনো প্রকল্পে ব্যবহার করা যায় কি না, তা বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ- আইএমইডি।
বর্তমানে প্রকল্পটির মেয়াদ আছে এ বছরের জুন পর্যন্ত। রেল বিভাগ চাইছে মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হোক।ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বৃদ্ধির এই প্রস্তাব শিগগিরই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
বর্তমানে দোহাজারী-কক্সবাজার অংশের কাজ ৬৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কোনো কাজই আমরা শুরু করিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী- দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রথম পর্যায় শেষ করার পর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার কথা ছিল।
“কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে আপাতত দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু না করার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে এখন শুধু দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১০১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।“
ঘুমধুম অংশের কী হবে, সে বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারছেন না প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, “আমরা এখন দোহাজারী-কক্সবাজার অংশের কাজ করছি।আর রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ বন্ধ রয়েছে।
“ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের আওতায় মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনে মিয়ানমারের অংশে কাজ শুরু করেনি। তাই মিয়ানমার কাজ শুরু করলে আমরাও দ্রুত সময়ে কাজ শেষ করে মিয়ানমারের সঙ্গে রেল লাইন সংযোগ করে দিতে পারব।”
রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ বাতিল করা হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বাতিল বলা যাবে না, স্থগিত বলা যেতে পারে।”
১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা আর বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হচ্ছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এডিবির সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে, তাতে অংশভিত্তিক অর্থছাড়ের শর্ত রয়েছে।
“এখন কক্সবাজার পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হলে হয়ত ঘুমধুম অংশের অর্থছাড় শুরু করবে। তখন ওই অংশের কাজ শুরু করা হবে।”
এদিকে সম্প্রতি প্রকল্পটি পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএমইডি। তাতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়কে শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
একইসঙ্গে ওই সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) জানাতে হবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে ইআরডিকে অর্থায়নকারী সংস্থা এডিবির সঙ্গে বৈঠকে বসতে হবে।
“এ প্রকল্পের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে সংশ্লিষ্ট অন্য প্রকল্প (যেমন চট্টগ্রাম হতে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন পুনর্বাসন, ব্রডগেজ রূপান্তর, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমুদ্র বন্দরের সাথে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা) বাস্তবায়ন করা যায় কি না মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে।“
মেয়াদ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার অংশে কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সময় ও চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারকে জমি অধিগ্রহণ করে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
“তাই প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতিও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেনি ঠিকাদাররা। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির (সেক্টর-২) মহাপরিচালক মো. জহির রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রেল মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে যে, এই প্রকল্পের রামু হতে ঘুমধুম অংশের কাজ পরে করা হবে। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত অংশ দ্রুত শেষ করতে চায়। তাই আমরা এই উদ্বৃত্ত অর্থ এডিবির সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য কোনো প্রকল্পে ব্যবহার করা যায় কি না ভেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছি।”
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ করার কথা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে।
কিন্তু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পটির ১২৯ কিলোমিটার রেললাইন তৈরির জন্য প্রায় ১ হাজার ৭৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এই বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণেই অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন।
এরপর প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য এডিবিকে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয় সরকার। এডিবি বিশদ সমীক্ষা পরিচালনা করে ট্রান্স এশিয়ান রেল লাইনের আওতায় প্রকল্পটিতে অর্থায়নে সম্মতি দেয়। এরপর ২০১৭ সালে প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পটির ব্যয় গিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
তারপর প্রকল্পটিকে ‘ফার্স্ট ট্র্যাকভুক্ত’ করে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি), চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি), বাংলাদেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এবং ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, “প্রকল্পটির বাস্তবায়নের প্রথমদিকে, অর্থাৎ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শুধু জমি অধিগ্রহণেই অনেক সময় ক্ষেপণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত দোহাজারী থেকে রামু অংশের প্রায় ৯৯ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে।”
এরপর মূল কাজের শুরুতেই মহামারী হানা দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “মহামারীর সময় বিদেশি ঠিকাদার ও পরামর্শক বেশিরভাগ সময় বিদেশে ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে দেশে লকডাউন থাকায় দেশীয় জনবলও ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি।
“সব মিলে কাজ শেষ করতে না পারায় বাধ্য হয়ে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। আশা করছি, তার আগেই আমরা প্রকল্পটি শেষ করতে পারব।”