ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলের দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ ও নৃশংস যুদ্ধ হতে যাচ্ছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে; তার মধ্যে জেলেনস্কি শনিবার জয়ের ব্যাপারে এই আশবাদ ব্যক্ত করলেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
“দখলদাররা ইউক্রেইন ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে এমন দিন যে এগিয়ে আসছে, তা তাদের দেখাতে সক্ষম হবো আমরা,” শনিবার রাতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এমনটাই বলেছেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট।
তিনি যে ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, নতুন বক্তব্যে তাই প্রতিফলিত হয়েছে।
এর আগে জেলেনস্কি সপ্তাহের পর সপ্তাহ পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর কাছে ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে দূরপাল্লার, ভারী অস্ত্রশস্ত্র চেয়ে গেছেন, না দিতে চাইলে তাদেরকে লজ্জা দিয়েছেন। শনিবারের বক্তব্যে তাকে অস্ত্রের জন্য হাহাকার করতে দেখা যায়নি।
সমর বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলো সম্প্রতি ইউক্রেইনে ট্যাংক, হাউইৎজার, প্রাণঘাতী ড্রোন, সাঁজোয়া যান ও যে পাহাড় পরিমাণ গোলাবারুদ ঢেলে দিচ্ছে তা সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে শক্তিশালী রুশ সামরিক বাহিনীকে আটকাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
তুমুল যুদ্ধ চললেও ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণে অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ায় সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রাশিয়ার ‘বড় কোনো অর্জন’ নেই বলে শনিবার সংঘাত নিয়ে সর্বশেষ মূল্যায়নে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
তারা বলছে, রাশিয়া মারিউপোলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার দাবি করলেও সেখানে এখনও ব্যাপক যুদ্ধ চলছে, যা শহরটি দখলে রুশ বাহিনীর চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে এবং দনবাস অঞ্চলে অগ্রযাত্রাকেও ব্যাহত করছে।
পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধে গেরিলা কায়দায় দ্রুত আক্রমণ করে পালিয়ে যাওয়ার কৌশল খুব একটা কাজে আসবে না বুঝতে পেরেই ইউক্রেইনকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার পথে হাঁটছে এর পশ্চিমা মিত্ররা। দনবাস অঞ্চলে উন্মুক্ত ভূমি বেশি থাকায় সেখানে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান বেশি কার্যকর হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কানাডা শুক্রবার ইউক্রেইনে এম৭৭৭ হাউইৎজারসহ ভারী কামান ও সাঁজোয়া যান বিধ্বংসী গোলাবারুদ পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। আগের দিনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেইনে আরও ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
রাশিয়া এখন পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে বড় কোনো সফলতা অর্জন করতে না পারলেও তারা ইউক্রেইনীয় বাহিনীর দুর্বল পয়েন্ট খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে এবং এরপর তুমুল আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে বলে ধারণা করছে ইউক্রেইনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা।
মারিউপোলে লড়াই করা রুশ বাহিনীর একাংশ এরই মধ্যে শহরটি ছেড়ে দনবাস ফ্রন্টে রওনা হয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা।
ইউক্রেইনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের সেক্রেটারি ওলেক্সি দানিলভ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, কিইভ হেলিকপ্টারে করে রাতের আঁধারে মারিউপোলের ইস্পাত কারখানায় অবরুদ্ধ সেনাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছে দিতে পেরেছে।
শহরটিতে এখনও লাখখানেক বেসামরিক আটকা পড়ে আছেন এবং তারা রুশ দখলদারদের অধীনে কষ্টকর জীবনযাপন করছেন বলে জানিয়েছেন ইউক্রেইনের উপপ্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশ্চুক।
রাশিয়া এখন ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলের দিকে নজর দিলেও শনিবার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ওডেসার উপকণ্ঠে তাদের ছোড়া দুটি ক্ষেপণাস্ত্র একটি আবাসিক এলাকায় আঘাত হানার পর তিন বছরের এক শিশুসহ অন্তত ৬ জন নিহত ও ১৮ জন আহত হয়েছে বলে ইউক্রেইনের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা টুইটারে লিখেছেন, ওডেসায় হামলার ‘একমাত্র উদ্দেশ্য’ ছিল ‘ত্রাস সৃষ্টি করা’।
“সভ্যতা এবং যারা শান্তিপূর্ণ শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে তাদের মধ্যে একটা প্রাচীর দরকার,” বলেছেন তিনি।
শুক্রবার রাশিয়ার এক জেনারেলের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, রাশিয়া কেবল ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, তার লক্ষ্য মলদোভা পর্যন্ত বিস্তৃত ইউক্রেইনের দক্ষিণের অঞ্চলও।
শনিবার রাতে জেলেনস্কি রুশ এই জেনারেলের ভাষ্য নিয়েও বলেছেন।
“অনেকবার আমি যা বলেছি, এই বক্তব্যও তাই বলছে। ইউক্রেইনে রাশিয়ার এই আক্রমণ কেবল শুরু, তারপর তারা অন্য দেশও দখলে নিতে চায়,” বলেছেন তিনি।
সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য রুশ জেনারেল রুস্তম মিনেকায়েভের ইঙ্গিত নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন্। তাদের ভাষ্য, রুশ জেনারেল ইউক্রেইন ও এর মিত্র, সমর্থকদের বিভ্রান্ত করতেই এমনটা বলেছেন।
পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক লড়াইয়ের মধ্যে থাকা রুশ বাহিনীর পক্ষে একই সঙ্গে দক্ষিণেও লড়াইয়ে নামা বেশ কঠিন হবে বলেও তাদের অনুমান।
তবে রুশ জেনারেলের ওই মন্তব্য মলদোভাকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। সাবেক এই সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের ‘ট্রান্সনিস্ট্রিয়া’ নামে পরিচিত একটি অংশ ১৯৯২ সাল থেকেই মস্কো সমর্থিত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার রুশভাষীরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, মিনেকায়েভের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে মলদোভার সরকার দেশটিতে থাকা রুশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বলেছে, রুশ জেনারেলের বক্তব্য ‘কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয়, অবাস্তবও’ এবং এই ধরনের বক্তব্য কেবল ‘উত্তেজনাই বাড়াবে’।