ক্যাটাগরি

‘পোত্তেক মরা পরিবারোত থ্যাকি চাকরি দিব্যার চাচিলো, দ্যায় নাই’

২০১৩
সালের এই দিনে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা ঘটে। রাজধানীর অদূরে সাভার
বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আট তলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে
গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজারখানেক গার্মেন্ট শ্রমিককে।

এর মধ্যে গাইবান্ধার
নারীসহ ৪৯ জন শ্রমিক নিহত, ১১ জন নিখোঁজ ও শতাধিক আহত হন বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন
কার্যালয় জানায়। ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর অনুদান হিসাবে তিন দফায় নিহতদের পরিবারপ্রতি
এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এরপর বিগত নয় বছরে আর কোনো আর্থিক সহায়তা মেলেনি।
সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবার পিছু একজনের চাকরির কথা বলা হলেও তা শুধু প্রতিশ্রুতি
হিসেবেই রয়ে গেছে।

শনিবার সরজমিনে
বেশ কয়েকটি শ্রমিক পরিবারে গিয়ে দেখা যায় তাদের দুর্দশার চিত্র। এর মধ্যে রানা প্লাজার
ভবন ধসে নিহত সাদুল্লাপুর উপজেলার কিশামত হলদিয়া গ্রামের স্মৃতি রাণীর (২৫) পরিবারের
অবস্থা বেশ করুণ।

স্মৃতি রাণীর বোন
মাধবী রাণী জানান, সেসময় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে তার পরিবারকে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা
দেওয়া হয়। এরপর নয় বছর চলে গেছে। কিন্তু আর কোনো অনুদান পাননি।

“প্রধানমন্ত্রীর
অনুদানের টাকার চেক দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, আমাদের পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়া
হবে। কিন্তু নয় বছর পেরিয়ে গেল, চাকরি তো দূরের কথা, কেউ খোঁজও নেয়নি।”  

একই ইউনিয়নের দক্ষিণ
ভাঙ্গামোড় গ্রামের দিনমজুর ওয়াহেদ আলীর ছেলে সবুজ মিয়া (১৮) রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়।
ঘটনার ১৬ দিন পর মুঠোফোনের সূত্র ধরে ছেলের হাড়গোড় পায় বাবা-মা।

সবুজ মিয়ার নিকটাত্মীয়
শফিউল ইসলাম বলেন, “সোরকার পোত্তেক মরা (নিহত) পরিবারোত থ্যাকি এ্যাক জনাক করি চাকরি
দিব্যার চাচিলো। আজো চাকরি দ্যায় নাই।“

এ ছাড়া রানা প্লাজার
ভবন ধসে একই গ্রামের আবদুল বারীর মেয়ে বিথী খাতুন (২১) ও সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা খাতুন
(২২) নিখোঁজ হন। এখনও তাদের সন্ধান মেলেনি।

আবদুল বারী বলেন,
“ট্যাকা পাওয়া তো দূরের কতা। সোরকার খোঁজও নেয় নাই।”

ডান হাত হারানো
সাদুল্লাপুর উপজেলার চকগোবিন্দপুর গ্রামের রিক্তা খাতুন (২৮) অভাবের কারণে ২০০৯ সালে
রানা প্লাজার একটি কারখানায় চাকরি নেন।

রিক্তা খাতুন বলেন,
“রানা প্লাজা ধসের দিন পোশাক কারখানায় কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ হৈ-চৈ শুনে দৌড় দেই।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে ছাদের নিচে চাপা পড়ি। ডান হাতের ওপর ইটের দেয়াল ভেঙে পড়ে। চার দিন
পর করাত দিয়ে হাত কেটে আমাকে বের করা হয়। দুই মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে
আসি।”

তিনি আরও জানান,
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ১২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তার আছে। সেই সঞ্চয়পত্রের মাসিক
১০ হাজার টাকা সুদ দিয়ে তার সংসার চলছে।

তবে ঘটনার সময় সরকার
পরিবারের একজনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আজও দেয়নি বলে জানান রিক্তা।

বাম পা হারানো সুন্দরগঞ্জ
উপজেলার সাতগিরি গ্রামের লাভলী খাতুন (২৬) বলেন, সেসময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায়
১০ লাখ টাকা পান। যা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির
কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে স্বামীকে একটি হালচাষের ট্রাক্টর কিনে দেন। পাশাপাশি তিনি
বাড়িতে একটি মুদি দোকান শুরু করেন। কিন্তু মূলধনের অভাবে দোকানটি এখন বন্ধ।

লাভলী বলেন, “আশা
নিয়ে চাকরি করছিলাম। সংসারে অভাব থাকবে না। কিন্তু তার বদলে বাম পা হারালাম। পা হারিয়ে
ক্রাচে ভর দিয়ে চলছি। কিন্তু পা হারানোর জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার দেখতে পেলাম না।

“পা হারাক, কিন্তু
সেই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার দেখে যেতে পারলে আত্মায় শান্তি পেতাম।”

লাভলীর স্বামী আনারুল
ইসলাম বলেন, স্ত্রীর পা নেই, কিন্তু তারা দুজনই সংসারের কাজ করছেন। স্ত্রী বসে বসে
দোকান করত। কিন্তু মূলধনের অভাবে এখন সেটি বন্ধ।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন
কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এস এম ফয়েজ উদ্দিন বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার পরপরই
সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতের পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এরপর তাদের পুনর্বাসনের
বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনও সরকারি নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন:

রানা প্লাজায় বাবা-মা হারানোদের আশ্রয় অরকা হোমস
 

রানা প্লাজা ধস: হত্যা মামলায় ৯ বছরে কেবল বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ