রুশ বাহিনীর আগ্রাসনে ভারত নিন্দা তো জানায়ইনি, উল্টো পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেলের দাম কমলে বিশেষ মূল্য ছাড়ে সেখান থেকে তেল কিনেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য চীনের উপর খড়গহস্ত হলেও ভারতের প্রতি পশ্চিমাদের নমনীয়তার কারণ খুঁজেছে সিএনএন।
গত মাসেই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের জন্য ভারত পশ্চিমাদের নিন্দা কুড়িয়েছে। কিন্তু এই মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পরই সুর বদলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাইডেন মোদী ‘উভয় দেশের জনগণের মধ্যে গভীর সম্পর্ক’ ও ‘মূল্যবোধ শেয়ার’ নিয়ে কথা বলেন।
এরইমধ্যে শুক্রবার উভয় দেশের বাণিজ্যে নিয়ে নিয়ে কথা বলতে দিল্লি পৌঁছান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এসব কিছুই হচ্ছে তখন, যখন রাশিয়ার বিষয়ে ‘পার্থক্যগুলো’ স্পষ্ট।
এখন পর্যন্ত ইউক্রেইন নিয়ে ভারতের অবস্থান অনেকাংশে একই রয়ে গেছে। ভারত এখনও রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তা দরে তেল কিনছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, ভারত ২০২১ সালে যে পরিমাণ তেল কিনেছে, ২০২২ সালের প্রথম কয়েক মাসেই সেই পরিমাণ কিনে ফেলেছে…এবং এখন পর্যন্ত মস্কোর আগ্রাসনের বিষয়ে চুপ রয়েছে।
গত ৭ এপ্রিল রাশিয়াকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে ভোট হলে সেখানেও ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ভারত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত পশ্চিমকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ‘ক্লাস’ করিয়ে দিল।
চীনের উত্থান ঠেকাতে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের কাছে রাশিয়ার চেয়ে বিশ্ব শান্তির জন্য বড় হুমকি চীন।
অথবা লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক হর্ষ ভি. পান্ত যেমন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে সহযোগিতার ক্ষেত্রে তার ভারতকে বিবেচনা করা উচিৎ।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ?
চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি, স্থল ও সমুদ্রে আগ্রাসীভাবে নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করা এবং ছোট প্রতিবেশী দেশের উপর তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব দিল্লি ও ওয়াশিংটন উভয়ের কাছেই অস্বস্তির কারণ।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমলে চীনের সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত চোরাগোপ্তা যুদ্ধ বিমান এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ক্রমবর্ধমান অস্ত্রাগার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
দিল্লিতে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রধান পান্ত বলেন, এই চীনকে দমাতে ওয়াশিংটনের পরিকল্পনায় রয়েছে ভারতসহ জাপান ও অস্ট্রেলিয়া, যারা নিরাপত্তা গ্রুপ কোয়াডের অন্তর্ভুক্ত।
এদিকে প্রতিবেশী চীনকে নিয়ে ভারতের নিজেরও উদ্বেগ রয়েছে। হিমালয় সীমান্তে উভয় দেশরই সেনা অস্থিরতা রয়েছে। কয়েক বছরের চলমান অস্থিরতায় কয়েক ডজন প্রাণহানি হয়েছে।
সীমান্তে সমর সরঞ্জাম বাড়াতে ভারত ব্যাপকভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল।
চীনের বিষয় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগগুলো বাইডেন ও মোদীর বৈঠকের পর পরিষ্কার হয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন সতর্ক করেন, চীন ‘আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস” করতে চাইছে।
অস্টিন বলেন, “সামরিক সম্পর্কের মাত্রা বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত নতুন সুযোগ চিহ্নিত করেছে।”
ভারতের তক্ষশীলা ইনস্টিটিউশনের চীনা স্টাডিজের ফেলো মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, “এটি একটি বিষয় যে…ইউক্রেইনের ব্যাপারে তাদের পার্থক্য যাই হোক না কেন…‘প্রত্যেকের জায়গা থেকে একে অপরের গভীর বোঝাপড়া’ ছিল।”
চীনের বিরুদ্ধে হৈ চৈ, ভারতের ক্ষেত্রে নীরব
চীনকে নিয়ে যে উদ্বেগগুলো রয়েছে, তা বুঝতে সাহায্য করবে কেন ওয়াশিংটন রাশিয়ার কর্মকাণ্ড নিয়ে চীনের সমালোচনা করে যাচ্ছে আর ভারতের ক্ষেত্রে কেন নীরব রয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে ইউক্রেইন যুদ্ধে ভারত ও চীনের একই অবস্থান রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। উভয়ই নিজেদেরকে নিরপেক্ষ অব্স্থানে রেখেছে। যুদ্ধেবিরোধীদের তর্জন-গর্জনের পরিবর্তে উভয় দেশই শান্তির আহ্বান জানিয়েছে। আবার উভয়েই ইউক্রেইনে হামলার নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছে।
দুই দেশেরই রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে, যা তারা ঝুঁকিতে ফেলতে চায় না।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা দেন, তাদের সম্পর্ক ‘কোনো সীমা’য় আটকে থাকবে না। অন্যদিকে ভারত ৫০ শতাংশেরও বেশি সামরিক সরঞ্জাম রাশিয়া থেকে কেনে।
কেওয়ালরামানির মতে, কিন্তু এই মিলগুলো কেবলই ভাসা-ভাসা। প্রকৃতপক্ষে ‘বিশাল পার্থক্য’ রয়েছে।
“চীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করেছে এবং সংঘাতের জন্য বারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নেটোকে দোষারোপ করছে। রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি এখানে তুচ্ছ। ন্যাটো পূর্ব দিকে প্রসারিত হওয়ার কারণে ইউক্রেইনে সংকট তৈরি হয়েছে।”
চীনের রাষ্ট্রপরিচালিত গণমাধ্যমগুলোও রাশিয়ার দিকগুলো প্রচার ও ‘ভুল’ তথ্য ছড়িয়েছে, বলেন তিনি।
অন্যদিকে ভারত নেটোর সমালোচনা থেকে সরে এসেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতপার্থক্য কমাতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। যুদ্ধের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অবস্থানেও সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটির এস রাজারত্নম স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহযোগী অধ্যাপক লি মিংজিয়াং বলেন, “মোদী ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্ত চীনের নেতারা তা করেননি।”
এ মাসে জাতিসংঘে ভারতের রাষ্ট্রদূত ইউক্রেইনের বুচায় বেসামরিক লোকদের হত্যাকাণ্ডকে ‘গভীর উদ্বেগের’ বলে মন্তব্য করেন। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন একইভাবে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছেন। দোষারোপ বন্ধ করে ‘সব পক্ষকে’ ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ এড়ানোর’ আহ্বান জানিয়ছেন।
জটিল সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্রও স্বীকার করতে পারে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন পথ রয়েছে।
ব্লিংকেন উল্লেখ করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ‘কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছে’, যে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি।
এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের কারণে হতে পারে। সে সময়ে ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ছিল। ১৯৭০ এর দশকে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকতে থাকে এবং একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেওয়া শুরু করে।
এটি হয়েছিল যখন রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করা শুরু করেছিল এবং ভারত আজও সামরিক সরঞ্জামের জন্য রাশিয়ার উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
২০১৮ সালে ভারত রাশিয়ার সঙ্গে একটি এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেমের জন্য ৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি করে। যদিও চুক্তিটি সম্ভাব্যভাবে ওয়াশিংটনের ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাডভার্সারি থ্রু স্যানকশন’ আইনের সাংঘর্ষিক ছিল। ২০১৭ সালের ওই আইনে ইরান, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়ার অস্ত্রের উপর ভারতের নির্ভরতা ইউক্রেইনে মস্কোর পদক্ষেপের নিন্দা করার ক্ষমতাকে সীমিত করেছে। এমনকি গত ডিসেম্বরে দিল্লি সফরের সময় পুতিনকে ‘প্রিয় বন্ধু’ অভিহিত করেছিলেন মোদী।
‘সকলের সমর্থনপুষ্ট’
অধ্যাপক হর্ষ ভি পান্ত বলেছেন, এই সবকিছু এমন একটি অবস্থানের দিকে নিয়ে গেছে যেখানে ভারতকে ‘সব পক্ষের সমর্থনপুষ্ট’।
মস্কো ভারতের পাশেই রয়ে গেছে। ছাড়ে তেল বিক্রি করতে আগ্রহী হয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এ মাসে দিল্লিতে তার অংশীদারের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘একতরফাভাবে’ না দেখার জন্য ভারতের প্রশংসা করেছেন।
আবার ২০১৪ সালে মোদীর নির্বাচনের পর থেকে পশ্চিমাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বার্ষিক ৮০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যের তুলনায় ভারত-মার্কিন বাণিজ্য বার্ষিক ১১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতও মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের একটি প্রধান গ্রাহক হয়ে উঠেছে।
তা সত্ত্বেও মোদীর সঙ্গে বাইডেনের সাম্প্রতিক বৈঠকে অস্বস্তিকর ইঙ্গিতও ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার ভারতীয় প্রতিপক্ষকে রাশিয়ার তেলের ব্যবহার না বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। এর পরিবর্তে অন্য জায়গা থেকে তেল সংগ্রহ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। ভারত তার মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ আমদানি করে, যেখানে রাশিয়া থেকে ৩ শতাংশের বেশি পায় না।
অধ্যাপক পান্ত বলেন, “মনে হচ্ছে ভারত একটি অনন্য ভারসাম্যমূলক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। ভারত আসলে এই সঙ্কট থেকে পোক্তভাবেই বেরিয়ে এসেছে। যা আসলেই কৃতিত্বপূর্ণ কাজ।”
আরও খবর: