ক্যাটাগরি

চন্দ্রিমা ও নিউ সুপার মার্কেটের জমি কার?

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় পুরনো এই দুটি বিপণি বিতান ঢাকার মিরপুর সড়কের পশ্চিমে ঢাকা কলেজের দক্ষিণ দিকের গা ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে।

সম্প্রতি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউ মার্কেট এলাকার দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের পর শিক্ষার্থীরা যে ১০টি দাবি জানিয়েছে তারই একটি এ দুই মার্কেটের জমি ঢাকা কলেজকে ফেরত দেওয়া।

জায়গাটি যে এককালে ঢাকা কলেজের ছিল না- সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা ও ব্যবসায়ীরা এমন দাবিও করেননি। ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষকরাও বলছেন, এই সম্পত্তি কালেভদ্রে বেদখল হয়েছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও নিউ সুপার মার্কেট সিটি করপোরেশনের ‘রেকর্ডভুক্ত’ জায়গা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঢাকা কলেজের এই দাবির পরে আমরা এটা আমাদের সম্পত্তি বিভাগে চেক করে দেখেছি এটা সিটি করপোরেশনের জায়গা। তাদের দাবি সঠিক নয়।”

ফরিদের ভাষ্য, “সর্বশেষ সিটি জরিপের রেকর্ডে এটা সিটি করপোরেশনের নামে। এটা একসময় হয়ত ঢাকা কলেজের ছিল। কিন্তু সর্বশেষ জরিপেও এটা সিটি করপোরেশনের নামে রেকর্ড হয়েছে।”

ঢাকা সেটেলমেন্টের সিটি জরিপ শেষের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিটি জরিপ বা মহানগর জরিপ মূলত ঢাকা মট্রোপলিটন শহর এলাকায় ১৯৯৫-২০২১০ সময়কালে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ।

ঢাকা কলেজের দাবি

নিজেদের ৬ একর জমি বিভিন্ন সময়ে বেহাত হয়েছে বলে দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এই জমি ফিরে পেতে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তাদের।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের পর বৃহস্পতিবার নিউ মার্কেটের আশেপাশের বিপণিবিতানও খুলেছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার এই সম্পত্তি বেদখল হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যক্ষ আবুল হোসেনকে ‘দায়ী’ করেন।

তিনি জানান, অধ্যাপক আবুল হোসেন ১৯৮৬-৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন।

পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে আজিমপুরের উত্তর পাশে গড়ে ওঠা কেনাকাটার স্থানটিই ৮০ এর দশকে সামরিক শাসক এরশাদের আমলে নিউ সুপার মার্কেট ও চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট এর মত আলাদা ব্লক হয়ে ওঠে।

সেলিম উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরশাদ সরকারের আমলে যখন মেজর জেনারেল (অব.)মাহমুদুল হাসান মেয়র ছিলেন, তখনই ঢাকা কলেজের এই জায়গাটা নিয়ে নেওয়া হয়েছে।

“লিজের কথা বলা হয়, কিন্তু আসলে লিজ নেয়নি। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট বরাবর পুরো জায়গাটাই ঢাকা কলেজের। নিউ সুপার মার্কেটও এতে পড়ে যায়। এটা আসলে ঢাকা কলেজের জায়গা। তখন এটা বৈধভাবে হয় নাই।”

এরশাদের শাসনামলে ঢাকার পুরনো আরেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সবকটি ছাত্রাবাসের দখল হারায়। ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি কয়েকটি ছাত্রাবাস ফিরে পেলেও সম্পত্তি উদ্ধারে ঢাকা কলেজে জোরালো আন্দোলন দেখা যায়নি।

সাবেক অধ্যক্ষ আবুল হোসেনকে ‘ম্যানেজ করে’ এই সম্পত্তি সিটি করপোরেশন নিয়ে নেয় মন্তব্য করে সেলিম বলেন, “ওই সময় ছাত্ররা আন্দোলনও করেছিল। কিন্তু এরপর আর সাহস করে নাই।

“বিভিন্ন সময় কথা হয়েছে, ইস্যু হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় কেউ যায় নাই। আমি অধ্যক্ষ থাকার সময়েও কোভিডের কারণে আসলে সেভাবে ইস্যুটা নিয়ে কাজ করতে পারি নাই।”

কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে এই জমি ঢাকা কলেজের হলে তা ফেরত দেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই শিক্ষক।

“এটার তো কাগজপত্র থাকার কথা। যাচাই-বাছাই করে যদি দেখা যায়, এটা ঢাকা কলেজের জায়গা, তাহলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। আর যদি সিটি করপোরেশনের হয়, তাহলেও সিটি করপোরেশনের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত।

“ঢাকা কলেজ থেকে তারা কীভাবে নিয়েছে, এটার ব্যাখ্যা দিক। কোনো প্রিন্সিপালের সেই ক্ষমতা নাই যে, সে কলেজের জায়গা লিজ দেবে। সেটা সরকারের মাধ্যমে, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হয়।”

অবশ্য বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়ার পরও সমাধান না আসায় ‘বেদখল জমি’ ফিরে পাওয়ার খুব একটা আশা দেখছেন না বলে জানান সেলিম।

তিনি বলেন, “এই জমি পাওয়ার জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এটা উদ্ধার করা যায়নি। এখানে এতো বড় মার্কেট হয়ে গেছে যে, ওদের উচ্ছেদ করাও কঠিন।

“সরকারের এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের অন্য কোথাও স্থানান্তর করতেই পারে সরকার। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা আমরাও চাই না।”

সংঘর্ষের পর সমঝোতায় শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার পর মার্কেটের জমিও ফিরিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইকরাম হোসেন।

“আমরা সবসময়ই শুনে আসছি যে, এগুলো কলেজের জমি। সেটি দখল করে মার্কেট করে তারা আমাদের সাথেই নানা সময়ে ঝামেলা করছে। এলাকার নকশা দেখলেই বুঝা যাবে যে, কলেজের পেটের ভেতর মার্কেট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

“সভ্য সমাজে একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি এভাবে নিয়ে নেওয়া যায় না। আমরা আশা করব, দখলদারদের ভুল ভাঙবে এবং তারা আমাদের জমি ফেরত দেবে।”

কলেজের আরেক শিক্ষার্থী রাদওয়ান হাসান বলেন, “সিটি করপোরেশন যেভাবেই এটি দখলে নিক, যেহেতু এটি আমাদের জায়গা; তারা দ্রুত এটি আমাদের বুঝিয়ে দিক। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা চাইলে এটি কঠিন কিছু হওয়ার কথা না।”

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য

এই দুটি মার্কেটের জমি এক সময় ঢাকা কলেজের নিজস্ব সম্পত্তি ছিল বলে স্বীকার করছেন নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরাও।

তবে তারা বলছেন, হাত বদলে জমির মালিক এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদের তৈরি করা মার্কেটে বৈধভাবেই দোকান বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করছেন কয়েকশ’ ব্যবসায়ী।

নিয়মকানুন মেনে আইনি প্রক্রিয়ায় মার্কেট বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে দাবি করে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মনজুর আহমেদ মনজু বলেন, “এই জায়গার মালিক সিটি করপোরেশন। আগে সিএন্ডবির অধীনে ছিল সব জায়গা। এরপর রোডস অ্যান্ড পিডব্লিউডি হয়।

“শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব জায়গাগুলো পিডব্লিউডির অধীনে চলে গিয়েছিল। এর মধ্যে কিছু জায়গা পিডব্লিউডি সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দিয়েছে আর কিছু জায়গা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিয়েছে।”

১৯৮৬ সালে এই জমির মালিকানা বদলে যাওয়ার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনের জায়গাটায় একটা মার্কেট ছিল। তখন এই জায়গায় একটি পরিপূর্ণ বড় মার্কেট করার জন্য পেছনের জায়গাটা ঢাকা কলেজের তৎকালীণ প্রিন্সিপাল আবুল হোসেন স্যারের কাছ থেকে সিটি করপোরেশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়ে নেয়।

“তারপর এই জায়গায় মার্কেট হয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এটা হয়েছে বলে আমরা জানি। এই অভিযোগ এর আগেও আমাদের শুনতে হয়েছে। এটা তো আসলে একটা জটিল প্রক্রিয়া।”

ঢাকা কলেজের জমিতে কীভাবে মার্কেট গড়ে উঠেছিল সে বিষয়ে জানতে চাইলে অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানকে ফোন দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

সমঝোতা বৈঠকের আগে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ১০ দাবি