ক্যাটাগরি

পৃথক পৃথিবী

এক হাতে আমার
আঙুল আরেক হাতে
সে শক্তভাবে মুঠো
করে ধরেছে আইসক্রিম। ভ্যানিলা ফ্লেভারে
চকলেট চিপ দেওয়া
আইসক্রিম। বরাবর
এই আইসক্রিমটাই তার
পছন্দ। কিছুদিন
আগে তার পাঁচ
বছরের জন্মদিনে মেয়ের
আবদার ছিল সামান্য। পাঁচটা ভ্যানিলা
ফ্লেভারে চকলেট চিপ
দেওয়া কোণ আইসক্রিম। একবারে নয়,
একটা একটা করে
তাকে দেওয়া হবে
এমনই ছিল প্রতিশ্রুতি।

আজ তার বরাদ্দ
পঞ্চম আইসক্রিমটা পাবার
দিন। পরিচিত
কফিশপে যাই, সেখানে
আইসক্রিম, কফি ইত্যাদি
নানা খাবারই মেলে। মেয়ের হাতে
আইসক্রিম দিয়ে আমি
এক কাপ কফি
নিই। এক
কোণায় একটা নিরিবিলি
টেবিল পেয়ে সেখানে
গিয়ে বসে পড়ি
আমি আর আমার
মেয়ে।

বাইরে বিকেল, সূর্য
তার আলোগুলো ধীরে
ধীরে গুটিয়ে নেবার
প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমি কফিতে চুমুক
দিই,
মেয়ে পরম তৃপ্তিতে
জিভ ঠেকায় আইসক্রিমে। আমরা শায়লার
জন্য অপেক্ষা করি। শায়লা আমার
স্ত্রী, মেয়ের মা। ছুটির দিন
আজ। আজ
আমরা তিনজন সিনেমা
হলে গিয়ে ছবি
দেখব। বাচ্চাদের
একটা এনিমেশন ছবি। শায়লা বেরিয়েছে
একটা কাজে।
কাজ সেরে সরাসরি
আসবে এই সিনেমা
হল লাগোয়া কফিশপে,
এমনই কথা তার
সঙ্গে।

নীল ফ্রক, দু’পাশে
চুলের ঝুঁটি বেঁধে
একটা রঙিন কাচপোকার
মতো পাঁচ বছরের
মেয়ে আমার পাশে
বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে
আইসক্রিম খায়।
আমিই সাজিয়ে এনেছি
তাকে। পাশে
বসে বাদামি কফির
দিকে চোখ রাখি। তৃপ্তিতে আইসক্রিম
খেতে খেতে, চোখ
আইসক্রিমের উপর স্থির
রেখেই মেয়ে আমাকে
বলে,
বাবা আজ রাতে
আমি মা’র
সঙ্গে ঘুমাব।

বেশ অনেকদিন হলো
মেয়েকে অন্য বিছানায়
ঘুমাবার অভ্যাস করাচ্ছি
আমরা। মাঝে
মাঝে এমন আবদার
করে সে।
আমি বলি, আজ
না মা, অন্য
আরেকদিন।

আজ ছুটির দিন। মন, শরীর
চাঙ্গা আমার।
আজ রাতটা মাটি
করবার কোনো ইচ্ছা
আমার নেই।
মেয়ে আইসক্রিম খাওয়া
থামিয়ে এবার আমার
দিকে সরাসরি তাকায়,
বলে,
তুমি কি এখনও
ছোট আছ? তোমার
কি ভূতের ভয়
করে?
তুমি কেন খালি
খালি মা’র
কাছে শুতে চাও?

মেয়ের কথায় কফি
চুমুক দিতে গিয়ে
হাত থেকে কাপ
আমার প্রায় উল্টে
যেতে নেয়।
আমি পরম কৌতুকে
তার দিকে তাকাই। কোনোরকম নিজেকে
সামলে নিয়ে বলি,
আমারও মাঝে মাঝে
ভূতের ভয় করে
মা। সেজন্যই
তো তোমার মা’র
কাছে শুই।
মেয়ে বলে, ছিঃ,
তুমি এত বড়
হয়েছ তবুও ভূতের
ভয় কর? আমি
বলি,
সব সময় করি
না,
মাঝে মাঝে করি।

আজ রাতে আমার
খুব ভূতের ভয়
হবে আমি জানি। এক হাতে
আইসক্রিম ধরে মেয়ে
গভীরভাবে তাকায় আমার
দিকে। আমার
কথার সত্যতা যাচাই
করবার চেষ্টা করে
যেন। মেয়ে
আমাকে বিশ্বাস করে
খুবই। আমার
অসহায় মুখ দেখে
সম্ভবত তার মনে
করুণা জাগে।
আমার চোখের দিকে
মনোযোগের সঙ্গে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থেকে বলে,
আচ্ছা যাও, আজ
রাতে তুমি মা’র
সাথে থাকো।
কিন্তু কাল আমাকে
অবশ্যই থাকতে দিতে
হবে।

 আমি হাঁফ
ছেড়ে বাঁচি।
বলি,
নিশ্চয়ই।

আমার এবং মেয়ের
ভূতের ভয় তাড়ায়
যে নারী সেই
শায়লার তখনও কোনো
দেখা নেই।
আমি লক্ষ্য করি
আইসক্রিম মেয়ের মুখের
চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। আমি টিস্যু
দিয়ে মেয়ের ঠোঁট-মুখ
পরিষ্কার করে দিই। কফিতে চুমুক
দিতে দিতে বলি,
মা স্কুলে তোমার
বেস্ট ফ্রেন্ড কে?
মেয়ে বলে, আমার
বেস্ট ফ্রেন্ড রোদেলা। জিজ্ঞেস করি,
রোদেলা কী করে?
মেয়ে বলে, রোদেলা
আমাকে চুইংগাম দেয়। রোদেলা আমাকে
অনেকদিন চুলের ফিতাও
বেঁধে দেয়।
আমি বলি, তোমার
কোনো ছেলেবন্ধু নেই?
মেয়ে বলে, না,
ছেলেরা পঁচা।
আমি জানতে চাই-
কেন,
কী করেছে ছেলেরা?
মেয়ে বলে- ছেলেরা
ফড়িং মেরে ফেলে। আমি কৌতূহলী
হই,
কেন,
কীভাবে ফড়িং মেরে
ফেলে? মেয়ে বলে,
সেদিন স্কুলে একটা
সুন্দর ফড়িং এসেছিল। ছেলেরা সব
মিলে সেই ফড়িংটা
ধরে ওর পাখা
ছিঁড়ে ফেলল।
ফড়িংটা আর উড়তে
পারল না।
মরে গেল।

মেয়ে আবার আইসক্রিমে
মনোযোগ দেয়।
আমি কোণার টেবিলে
বসে সামনের ভিড়ের
দিকে তাকিয়ে ভাবতে
থাকি, বোঝা যাচ্ছে
পুরুষ প্রজাতি সম্পর্কে
মেয়ের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা
মর্মান্তিক। ভাবতে
থাকি যত দিন যাবে
মেয়ের কি কেবল
বিবিধ রকম ফড়িং
মেরে ফেলা বালক,
যুবক, পুরুষের সঙ্গেই
দেখা হবে? নাকি
দেখা হবে এমন
কারও সঙ্গে যাকে
নিয়ে ফড়িং-এর
হালকা পাখায় ভর
করে সে উড়ে
যেতে পারবে তেপান্তরে?

আর কটা বছর
গেলে মেয়ের প্রথম
ডিম জন্মাবার সময়
আসবে। তার
শরীরের গোপন কোঠায়
আসবে ডিমের ঝাঁক। আর তার
ফড়িং মারা বালকদের
জন্মাবে বীজ।
মেয়ে যখন সযত্নে
তার ডিম আগলে
রাখবে শরীরে, বালকেরা হয়তো
তখন যত্রতত্র অপচয়
করবে তাদের বীজ। মেয়ে আমার
তখন এই সরল
বালিকা থাকবে না
আর,
হয়ে উঠবে রমণী। তারপর মাসের
বিশেষ কটা দিন
নিভৃতে মেয়ে নিজেকে
চিনবে নতুন করে। চিনবে তার
শরীরের স্বাতন্ত্র্য।
এরপর ছেলেরা তার
কাছে হয়ে উঠবে
আরও খানিকটা সুদূর,
অনেকখানি বলশালী, আরও
রহস্যময় এক প্রাণী। শরীর তার
চারপাশে তৈরি করবে
অসেতুসম্ভব একটা দূরত্ব।

কিন্তু প্রকৃতি তো
চাইবে সে নিকটবর্তী
হোক তার বিপরীত
শরীরের কারও।
এতে প্রকৃতির লাভ। প্রকৃতি চায়
নারী-পুরুষ নিকটবর্তী
হোক,
তাতে প্রজাতি রক্ষা
পাবে। কিন্তু
কেমন হবে আমার
মেয়ের এই বিপরীত
লিঙ্গের নিকটবর্তী হবার
অভিজ্ঞতা? সে কি
বিপরীত লিঙ্গের কাছে
কেবলই এক মূর্তিমান
শরীর হিসেবে দেখা
দেবে? তাদের চোখ
আর মন কি
কেবলই মনোযোগী হবে
মেয়ের ভেতর প্রকাশিত
নারীত্বের নানা অনুষঙ্গের
দিকে? ওরা কি
তার কাছাকাছি আসতে
চাইবে শুধুই ওর
পাখা ছিঁড়ে ফেলবার
জন্য? ওর মন
ভেঙে পাথরকুচি বানিয়ে
মরুভূমিতে ছড়িয়ে দেবার
জন্য? মেয়ে কী
করে মোকাবিলা করবে
এই আশ্চর্য রসায়ন?
ভুল করবে সে?
হয়তো আরও অগণিত
নারীর মতো গোপনে
চোখের জলে সে
শিখে নেবে তার
পথ। মেয়ে
হিসেবে চোখের জলের
উপর অবাধ অধিকার
আছে তার।
অন্তত তার ছেলে
প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি। সে নিশ্চয়ই
পার্থক্য করতে জানবে
কোন্ চোখের জল
বেদনার আর কোনটা
ছলনার।

সে ধীরে ধীরে
চিনে নেবে সেই
পথ যা কেবল
জানা থাকে নারীদেরই। সে জানবে
ঐ পথ আঁকাবাঁকা, তবু সে পথেই
চলতে হবে তাকে
নইলে তার পা
পড়বে সাপের শরীরে। কিন্তু সত্য
তো এও যে
নারী যেহেতু রানিও
সে হবে একদিন। অন্তত কোনো
এক রাজকুমারের কাছে। তাকে কি
সঠিক সময়ে, সঠিক
জায়গায় খুঁজে পাবে
সে?
সেই রাজকুমারের খোঁজে
তার মন কি
একখণ্ড তুলোর মতো
উড়বে দিক দিগন্তে?
বলা খুব দুরূহ
যে হাওয়ায় উড়তে
উড়তে সেই তুলার
খণ্ড কোথায় গিয়ে
পড়বে। পড়তে
পারে কোনো সবুজ
প্রান্তরে, অথবা কোনো
মহিষের রোমশ গায়ে
কিংবা স্রোতস্বিনী কোনো
নদীতে। কেউ
হয়তো তাকে বলবে
রাজকুমার খোঁজা প্রজাপতি
ধরবার মতোই।
পেছনে ছুটলে কিছুতেই
ধরা যায় না
তাকে, অথচ স্থির
হয়ে বসলে সে
প্রজাপতি আপনিই ধীরে
মাথার উপর এসে
বসে।

আমার মেয়ে স্থির
হয়ে বসবে হয়তো। হয়তো বাস্তবিক
এক রাজকুমার হাজির
হবে একদিন।
বলবে, ঝড় কখন
হয় জান? যখন
দুটো বিপরীত হাওয়ার
সংঘর্ষ বাধে।
কেন যে তুমি
এত বিপজ্জনক রূপসী
হলে আর কেনই
যে আমার এলো
যৌবন। ঝড়
এখন তো ঠেকানো
যাবে না আর। তারপর একটা
ঝড় উঠবে।
একটা উথাল-পাথাল
ঝড়ে সাগরের ঢেউয়ে
নাগরদোলার মতো দুলবে
ওরা। ঝড়
থামবে তারপর।
ঝড় থামলে ওরা
কি তীরে উঠবে?
তীরে উঠে ওরা
কি ঘর বাঁধবে?
নাকি পরস্পরকে বলবে,
চল আমরা আবার
অচেনা হয়ে যাই, সংসারী
হবে কি আমার
মেয়ে? নাকি সংসারকে
তার মনে হবে
সং  ই
সার?
যদি সংসারী হয়
তাহলে পাখি যেমন
একটা একটা করে
খড়কুটো এনে বাসা
বানায়, হয়তো সেও
তেমনি তার বসার
ঘর,
শোবারঘর একটু একটু
করে সাজাবে খুঁটিনাটি
আসবাবে। তারপর
রাত হলে যার
সঙ্গে ঘর বাঁধবে
সে,
সেই যুবক হয়তো
ভূতের ভয়ে এসে
শোবে তার পাশে। খানিকটা বিস্ময়,
খানিকটা বিচিত্র অনুভূতিতে
মেয়ের মনে হবে,
ও,
তাহলে এই সেই
বিখ্যাত কুমারীত্ব হারানো?

তারপর মেয়ে আমার
কি সন্তান জন্ম
দেবে? সন্তান জন্ম
দিলে হয়তো একটা
বাঘিনীর মতো তারপর
সে আগলে রাখবে
সেই শিশুকে।
সেই শিশু যখন
তার স্তনবৃত্তে মৃদু
মৃদু দাঁতবিহীন মাড়ি
বসাবে তখন হয়তো
তার বিশ্ব সংসারকে
মনে হবে তুচ্ছ। নাকি সংসারত্যাগী
হবে মেয়ে? হয়তো
এইসব বাৎসল্য, প্রবৃত্তি,
সম্পর্ক একটা বোঝা,
একটা ভার মনে
হবে তার।
মেয়ে বরং হয়তো
আগ্রহী হবে জীবনের
আরও গভীরতর নানা
অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর
খুঁজতে। রাত
জেগে অক্ষরের পর
অক্ষর সাজিয়ে সে
হয়তো তৈরি করবে
দ্বিতীয় জীবন।
হয়তো আকাশে মুষ্ঠিবদ্ধ
হাত তুলে বলবে
আমরা দুঃসময়ের সন্তান। বলবে, এই
পৃথিবীটা অবিন্যস্ত, দুঃশাসিত
পরিকল্পনাহীন, আসুন আমরা
একে বদলাই।

আমার কল্পনার মহাযান
যখন নক্ষত্র থেকে
নক্ষত্রে ছুটে চলেছে
তখন হঠাৎ লক্ষ্য
করি মেয়ে ডাকছে-
বাবা।

তাকিয়ে দেখি মেয়ের
আইসক্রিম খাওয়া শেষ। বলি, কী
মা?
মেয়ে বলে, আমি
হিসু করব।
বিপদে পড়ে যাই। কফিশপে মেয়েদের
যে টয়লেট আছে
সেখানে ওকে নিয়ে
একজন পুরুষ হয়ে
আমি কী করে
ঢুকি? আর এখানে
ছেলেদের যে টয়লেট
তাতে আছে শুধু
খোলা কিছু পুরুষ
ইউরিনাল, মেয়ের শরীর
সেই ইউরিনাল ব্যবহার
উপযোগী নয়।
আমি ফাঁপড়ে পড়ি। কোনো মহিলাকে
কী অনুরোধ করব
মেয়েকে মেয়েদের টয়লেটে
নিয়ে যেতে? কিন্তু
সেও তো একটা
খুব অস্বস্তির ব্যাপার। ফোন দিই
শায়লাকে। শায়লা
বলে সে পথে,
পৌঁছে যাবে খুব শীঘ্র। আমি মেয়েকে
অপেক্ষা করতে বলি
আর কিছুক্ষণ।

মেয়ে অসহায়ভাবে তাকায়
আমার দিকে।
আমরা যার যার
শরীরের ঘেরে বন্দি
হয়ে বসি থাকি
পাশাপাশি। আমাদের
পৃথক শরীর দুজনকে
দুটো পৃথক পৃথিবীতে
বসিয়ে রাখে।

 

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশুকিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়াকবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা নিজ স্কুলকলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নামঠিকানা ছবি দিতে ভুলো না!