ক্যাটাগরি

মুক্তির ছবি ‘মুক্তির গান’

আর এই ছবিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের জন্মেরও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। শিরোনাম দেখেই হয়তো তোমরা আন্দাজ করতে পেরেছ যে, আমি আজ তোমাদের বহুল আলোচিত ‘মুক্তির গান’ ছবিটির গল্প শোনাতে বসেছি।

এই ছবিটি বানানোর ইতিহাসের সঙ্গে দু’জন মানুষের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাদের একজন আমার বন্ধু তারেক মাসুদ, আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তোমরা অনেকেই হয়তো জানো ক’বছর আগে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সে ও আমার আরেক বন্ধু গুণী চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর অকালে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। তাই শুরুতেই চল তাদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই আমরা সবাই মিলে।

অপরজন তারেকেরই জীবন ও কর্মসঙ্গিনী, ক্যাথরিন, জন্মসূত্রে মার্কিন মুল্লুকের মেয়ে হলেও বাংলাদেশ, তারেক এবং তারেকের স্বপ্ন চলচ্চিত্রকে ভালবেসে এই দেশকেই নিজের দেশ বলে ভাবতে শিখেছিল।

তো এই দু’জন একবার গল্পচ্ছলে ‘মুক্তির গান’ ছবিটির অন্যতম প্রধান চরিত্র মাহমুদুর রহমান বেণুর মুখে, যিনি সম্পর্কে ছিলেন তারেকেরই ভাই, লিয়ার লেভিন নামে এক মার্কিন চিত্রনির্মাতার নাম শুনতে পায়, যে নাকি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেণুদের গানের দলটির অনেক ছবি তুলেছিল, তাদের সঙ্গে দিনরাত আঠার মতো লেগে থেকে। ব্যাস এই কথা শুনেই ছবিপাগল তারেক এই লোকটির সন্ধানে গোটা যুক্তরাষ্ট্র তোলপাড় করে ফেলে। আমি তখন সৌভাগ্যক্রমে তারেক-ক্যাথরিনের সঙ্গে এক বাড়িতেই থাকতাম, নিউ ইয়র্ক শহরের লাগোয়া স্ট্যাটেন আইল্যান্ড নামের একটা চমৎকার সবুজ, ছায়াঘেরা দ্বীপে।

‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

তাদের এই নাছোড়, গোয়েন্দাসুলভ অনুসন্ধানের ফল মিলল একদিন। ব্রকলিন এলাকার এক বাড়ির মাটির নিচের ঘর থেকে অবশেষে উদ্ধার পেল কয়েক হাজার ফুট, তালগোল পাকানো সেইসব ছবির ফিতার স্তুপ। তখন সেকি উত্তেজনা এই দু’জন বাংলাদেশপ্রেমী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-অনুসন্ধানী মানুষের চোখেমুখে! দিন নেই, রাত নেই, প্রায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে তারা তখন এই চিটে-পড়া সেলুলয়েডের দলা থেকে তিল তিল করে ছেঁকে তুলে আনতে লাগল মুক্তিযুদ্ধের অমূল্যসব চিত্র-দলিল।

আর সেইসব ছবির টুকরো জোড়া দিয়ে দিয়ে তারা একটা গল্পের কাঠামো ফুটিয়ে তুলতে লাগল, ধীরে ধীরে যা এক পর্যায়ে ‘মুক্তির গান’ ছবিটির রূপ লাভ করে। এখানে এই কথাটি বলার লোভ সামলাতে পারছি না যে, তারেকের অনুরোধে এই ছবিটির বাংলা ধারাভাষ্যটি লিখে দেবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সে যাক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে আর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে একদিন ছবিটির কাজ শেষ হলে, কালবিলম্ব না করে আমার এই বন্ধুদম্পতি ছবিটিকে বুকে জড়িয়ে দেশের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়।

সেটা ১৯৯৫ সালের কথা। অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসনের দীর্ঘ ধারাবাহিকতার পর বাংলাদেশে তখন কেবল গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। কিন্তু হলে কী হবে, দীর্ঘদিনের ইচ্ছাকৃত ইতিহাস-বিকৃতির কারণে তরুণ প্রজন্ম তখন স্বদেশের সঠিক ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না, আর জানলেও জানে ভুল আর বিকৃতভাবে। ইতিহাসের ছাত্র তারেক তখন তার সাধনসঙ্গিনী ক্যাথরিনকে নিয়ে প্রজেক্টর কাঁধে করে সারা দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে এই ছবি দেখানোর কাজ শুরু করে দেয়।

ঢাকা শহরের সিনেমা হলেও মুক্তি পায় ‘মুক্তির গান’। মানুষ তখন রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চিত্রায়িত সত্যিকারের যুদ্ধ আর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি; যেমন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবন আর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে স্বাধীনবাংলা শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যদের দেশাত্মবোধক গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করার আবেগমথিত দৃশ্যাবলি স্বচক্ষে দেখার জন্য।

এর ক’দিন বাদেই ছিল ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচন। এই ছবির বিপুল প্রভাব পড়ে সেই নির্বাচনী ফলাফলে। তরুণ ভোটারদের সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দীর্ঘ দুই দশক পরে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। ধীরে ধীরে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে শুরু করে। উদ্বুদ্ধ হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার কাজে। এর কিছুটা কৃতিত্ব অবশ্যই দাবি করতে পারে এই অমূল্য ঐতিহাসিক ছবি ‘মুক্তির গান’ আর তার দুই মেধাবী নির্মাতা তারেক ও ক্যথারিন মাসুদ। তাদেরকে সেলাম।

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!