যেমন ডাইনিং হলে খাবার খাওয়ার সময় প্রায়ই তার পোশাকে তরকারির ঝোল লেগে থাকতো। তার সহপাঠীরা অনেকেই মজা করে বলতো, কিরে তুই খেয়েছিস না তোর শার্ট খেয়েছে? বেচারা অসহায় ভঙ্গিতে উত্তর দিত, দুটোই। হাতে ঘড়ি পরলেও তিনি অন্যদের কাছে সময় জিজ্ঞেস করতেন। কথিত আছে তিনি প্রায় সকালেই পেস্টের বদলে কুল শেভিং ক্রিম দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতেন।
সেবার বিশ্বকাপ ফাইনাল চলছে। আমরা সবাই টিভি রুমে খেলা দেখার জন্য এসেছি। খেলা চলছে। সেই সাথে সমানে চিৎকার চেঁচামেচি। হঠাৎ দেখি সেই ভাই পেছনে বসে আছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা। সবাই এত চেঁচামেচি কেন করছে?
ভাইয়ের কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক হলাম। ভাবলাম তিনি মনে হয় মজা করছেন। আমি বললাম, আপনি জানেন না? আজতো ফাইনাল ম্যাচ।
ফাইনাল ম্যাচ? কিসের? তার মুখে বিস্ময়। আমি বললাম, ফুটবল বিশ্বকাপ। ভাই আপনি কি খেলা দেখতে আসেননি? তিনি বললেন, না তো। আমি বললাম, তো এখানে কেন এসেছেন?
তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, সবাই এসেছে তাই।
বিশ্বকাপের খেলাগুলো গভীর রাতে হওয়াতে আমরা সব খেলা দেখার অনুমতি পেতাম না। বিশেষ করে পরদিন নিয়মমাফিক ফিজিক্যাল ট্রেনিং (পিটি) অথবা প্যারেড থাকতো। তাছাড়া স্যারদের ধারণা ছিল, গভীর রাতে খেলা দেখার অনুমতি দিলে আমরা খেলা না দেখে অন্যকিছু দেখবো। কারণ তাদের মতে গভীর রাতে অনেক চ্যানেলেই উল্টাপাল্টা নাচ গান এবং ছবি দেখানো হয়।
তবে বিশেষ ম্যাচ দেখার অনুমতি মিলতো। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষক সবসময় নজরদারি করতেন। এক রাতের ঘটনা। ব্রাজিলের খেলা দেখার অনুমতি মিললো। আমরা সবাই খেলা দেখার জন্যে টিভি রুমে জড়ো হলাম। হঠাৎ ব্রাজিল গোল করায় ক্যামেরা চলে গেলো গ্যালারিতে সাম্বা নাচরত ব্রাজিলিয়ান নারীদের দিকে। ঠিক এই সময় স্যার ঢুকলেন। তিনি বেশ বিব্রতবোধ করলেন। খেলাধুলা সম্পর্কে স্যারের ধারণা তেমন একটা ছিল না। তিনি ভাবলেন আমরা বোধ হয় খেলা না দেখে উল্টাপাল্টা নাচগান দেখছি। তিনি চিৎকার করে হাউজ-বেয়াড়াকে ডেকে বললেন, হালিম, এখনই টিভি রুম বন্ধ করে দাও। ছেলেপেলে খেলা দেখার বদলে হাফপ্যান্ট পড়া মেয়েদের নাচ দেখছে। অস্তাগফিরুল্লাহ।
বিশ্বকাপের সময় আমাদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের পতাকা বানানোর ধুম পড়ে গেল। বিশেষ করে সবাই যে যার প্রিয় দলের পতাকা বানাচ্ছে। সে অনুযায়ী একদিন আমিও ব্রাজিলের পতাকা বানানো শুরু করলাম। কিন্তু পতাকা বানানোর মাঝপথে ‘গেমস’ এর বাঁশি পড়লো, বাধ্যতামূলক খেলাধুলা করতে নেমে গেলাম। ‘গেমস’ এর সময় মিশকাত ভাই বললেন, রুম নং ৩২৭ ফল আউট। মিশকাত ভাই ছিলেন আমাদের ‘জুনিয়র অধিনায়ক’। আমাদের ওপর খবরদারি করার দায়িত্ব ছিল তার।
আমরা ৩২৭ নং রুমের বাসিন্দারা ‘ফল ইন’ থেকে বের হয়ে এলাম। তিনি কমান্ড দিলেন, স্টার্ট ফ্রন্টরোল। অর্থাৎ তিনি আমাদের ডিগবাজি দিতে বলছেন। ডিগবাজি এর সামরিক নাম ‘ফ্রন্টরোল’। আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কারণ, পানিশমেন্ট খাওয়ার মতো আমরা কিছুই করিনি। যাই হোক, সিনিয়রের আদেশ। আমরা আমাদের অপরাধের কারণ জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। পানিশমেন্ট খেয়ে রুমে ফিরে দেখি অসমাপ্ত ব্রাজিলের পতাকা মেঝেতে পড়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না তিনি রুম চেকিং করতে এসে ব্রাজিলের পতাকা দেখে আমাদের ওপর খেপেছেন এবং পানিশমেন্ট দেওয়ার কারণ এটাই। পরে জানলাম, তিনি আসলে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার।

অলঙ্করণ: পলাশ শাকিল, সাবেক ক্যাডেট ও প্রকৌশলী
বিশ্বকাপের সময় আমরা কলেজের ভেতরেই ঘরোয়া ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করতাম। এমন এক ফুটবল ম্যাচের গোল রক্ষকের দায়িত্ব পড়লো আশিকের। আশিক যথারীতি দায়িত্ব পালন করছে। বল তখন মাঠের ওই প্রান্তে। এমন সময় এক স্যার এসে বললেন, কী ব্যাপার? সবাই ফুটবল খেলছে, তুমি একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? আশিক বলল, স্যার আমি গোলরক্ষক।
স্যার তখন বললেন, তাতে কী হয়েছে? তুমিও ওদের সাথে যোগ দাও বাবা। সবাই বল নিয়ে ছুটোছুটি করছে। আর তুমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছ। যাও মধ্যমাঠে যাও।
আমাদের একজন স্টাফ (আর্মির নন-কমিশন্ড অফিসার) ছিলেন যার চেহারা অনেকটাই নাইজেরিয়ানদের মতো ছিল। আমরা মজা করে বলতাম- স্টাফ, আপনি কি নাইজেরিয়া সাপোর্ট করেন? স্টাফ আমাদের মজা বুঝতে পেরে বলতো- দেখো, আমি দেখতে নাইজেরিয়ানদের মতো হতে পারি, কিন্তু সাপোর্ট করি আর্জেন্টিনা।
আন্তঃহাউস ফুটবল ম্যাচ প্রতিযোগিতা চলছে। সোহরাওয়ার্দি হাউসের সাথে শেরেবাংলা হাউসের খেলা। রেফারি আমাদের একজন প্রিয় শিক্ষক। হঠাৎ একদল গোল করলো। রেফারি বাঁশি বাজিয়ে গোল বৈধ করার পর অপর পক্ষ থেকে অভিযোগ এলো বল আসলে পা নয় হাত দিয়ে জালে ঢুকেছে। স্যার অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন, তাতে কী হয়েছে? বল তো জালে ঢুকছে!
আমাদের এক বন্ধু ছিল, সে যা ভবিষ্যৎবাণী করতো ঘটতো ঠিক তার উল্টো। যেমন যদি সে বলতো আজ বৃষ্টি হবে তাহলে দেখা যেত সেদিনের রোদের প্রখরতা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। দেখতে দেখতে বিশ্বকাপ চলে এলো। আমার বন্ধুটি মহাউৎসাহে প্রতিটি ম্যাচের ভবিষ্যৎবাণী করতো আর ঘটতো তার ঠিক উল্টো। শুধু তাই নয়, সে যে দল সমর্থন করতো দেখা যেত সেই দলই হেরেছে।
আমরা তাই ওকে ‘অ্যান্টি পল’ নামে ডাকতাম। তখন ‘পল’ নামে একটি অক্টোপাস ভবিষ্যৎবাণী করে বেশ আলোচিত ছিল। এদিকে আমরা যারা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থক তারা প্রচণ্ড ভয়ে আছি। কারণ আমার বন্ধু দুই দলকেই সমর্থন করে। ফলে যা ঘটার ঘটলো। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা একে একে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল। আমার বন্ধুটিও দীর্ঘদিন নীরব। দেখতে দেখতে ফাইনালে গেলো ভিন্ন দুটি দল। এবার সে কোনভাবেই আর ভবিষ্যৎবাণী করে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও চুপচাপ থাকে। তাই আমরা কোনভাবেই নিশ্চিত হতে পারছি না এবার কে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে?
ফাইনালের রাত এলো অবশেষে। সবাই খেলা শেষ করে যে যার রুমে ফিরে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম কেউ একজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। আগ্রহ নিয়ে কাছে গিয়ে দেখি, আমার সেই বন্ধুটি। বেচারার হাতে ব্যানার, যাতে লেখা ‘নেদারল্যান্ডস’। আমাদের দেখে তড়িঘড়ি করে লুকানোর চেষ্টা করছে।
কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |