যার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি তার উদ্দেশে লেখা ভালোবাসার চিঠি
তার নাম জেমস ফিপস। ১৭৯৬ সালে তার বয়স যখন মাত্র ৮ বছর, তখন তাকেই প্রথম আধুনিক টিকা দিয়েছিলেন এডওয়ার্ড জেনার।
এই টিকা তাকে গুটিবসন্তের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। উত্তর আফ্রিকার চিকিৎসক, কনস্টান্টিনোপলের দাদি-নানি এবং চিনের মিং রাজবংশের ডাক্তাররা পরবর্তী প্রজন্মকে অসুস্থতা ও মৃত্যু থেকে রক্ষার উপায় খুঁজে পেতে যুগের পর যুগ ধরে যেসব উদ্ভাবন করে গেছেন, তার অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছিল এই টিকা।
পরবর্তী প্রজন্মকে অসুস্থতা ও মৃত্যু থেকে রক্ষার সেই অভীষ্ট আমার খুব চেনা। আমি ইউনিসেফে কর্মরত রয়েছি। গত ৭৫ বছর ধরে আমরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকা সংগ্রহকারী; আমরাই পৃথিবীর ৪৫ শতাংশ শিশুকে টিকা দিই। আমিও একসময় শিশু ছিলাম। যে শিশুদের নিয়ে আমরা কাজ করি, তাদের অনেকের মত আমিও হয়ত টিকা না নিলে আজ বেঁচে থাকতাম না। তাই, ব্যক্তিগতভাবে আমার, ইউনিসেফের সব কর্মীর এবং টিকার কল্যাণে বেঁচে থাকা প্রতিটি শিশুর পক্ষ থেকে এটি এক ভালোবাসার চিঠি।
কারণ আমরা ধন্যবাদ জানাতে চাই।
ভাইরাসবিদ জোনাস সল্ক, পোলিও প্রতিরোধে প্রথম টিকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ!
ক্যাটি ক্যারিকো, আপনাকে ধন্যবাদ! এমআরএনএ নিয়ে আপনার সারাজীবনের কাজ আমাদের কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করেছে।
নোবেল বিজয়ী ম্যাক্স থিলার, আপনাকে ধন্যবাদ! আপনার দল মশাকে নিজের রক্ত খাইয়ে পীতজ্বরের প্রতিষেধক টিকা তৈরি করেছে।
কারখানায় টিকার শিশি ভর্তি করেন যে কর্মীরা, আপনাদের ধন্যবাদ!
টিকা ঠাণ্ডা রাখার সৌরচালিত ফ্রিজ যারা তৈরি করেছেন, আপনাদের ধন্যবাদ!
প্রবল বর্ষার মধ্যে বানে ভাসা নদী পাড়ি দিয়ে, কিংবা বরফ মাড়িয়ে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে অবিচল চিত্তে শিশুদের কাছে টিকার প্রথম ডোজ পৌঁছে দিচ্ছেন যে নাবিক, পাইলট আর চালকরা, আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
পাকিস্তানের উটদেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। গত বছর দুই সপ্তাহের টিকাদান অভিযানে ৯ কোটির বেশি শিশুর জন্য হাম ও রুবেলা প্রতিষেধক টিকা বহন করেছিল তারা।
সকল ডাক্তার ও নার্সকে ধন্যবাদ, তারা নিশ্চিত করেন, সুঁই ফোটানোর সময় যেন খুব বেশি ব্যথা না লাগে।
এলভিস প্রেসলিকে ধন্যবাদ! ১৯৫৬ সালে পোলিও টিকার প্রচার শুরুর জন্য মঞ্চে ওঠার আগে তিনি নিজেও নিয়েছিলেন টিকা, কারণ ‘রাজারাতো এমনই করেন’।
এটা আপনাদের সকলের প্রতি ভালোবাসার চিঠি। ‘শান্তির দিনগুলোতে’ পৌঁছাতে আমাদের ভালোবাসাই প্রয়োজন। শিশুদের টিকাদানের জন্য ইউনিসেফ যখন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করে; ১৯৮০-র দশকে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক জিম গ্র্যান্ট যখন বিশ্বব্যাপী শিশুদের টিকাদানের হার ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮০ শতাংশে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন ১৯৬৬ সালে ‘এসেনশিয়াল প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন’ চালু করে মাত্র ১১ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করতে সক্ষম হল, এই ভালোবাসারই প্রয়োজন ছিল।
প্রতি বছর টিকা প্রায় ৩০ লাখ শিশুর জীবন বাঁচায়। তবে কিছু শিশু এখনও টিকা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আজ আমরা অতিমারী থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করছি, তাই আমাদের কাছে প্রতিটি শিশুর কাছে পৌঁছানোর মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিশেষ সুযোগ এসেছে, এমন সুযোগ একটি প্রজন্মে হয়ত একবারই মেলে।
এই ভালোবাসার চিঠি আমাদের সরকার ও নেতৃবৃন্দের জন্যও; যারা স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্বের সাথে এগিয়ে নেন, কারণ আজ পর্যন্ত যা কিছু আমরা অর্জন করেছি, স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। আরও সামনে যদি এগিয়ে যেতে চাই, স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করাই তার একমাত্র পথ।
শুধু একজনকে ধন্যবাদ জানানোর বাকি আছে: সেটা আপনি। এটা আপনার জন্যও ভালোবাসার চিঠি, কারণ আপনি যদি টিকা নিয়ে থাকেন, বা আপনার শিশুকে টিকা দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আপনিও সেই হাতে হাত বাঁধা বন্ধনের অংশ, যা পুরো মানবজাতিকে সুরক্ষিত রাখছে।
নিষ্ঠা, সেবা ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানবজাতি কী করতে পারে, আপনিও তার জীবন্ত নজির। তাই ইউনিসেফের সব কর্মী এবং টিকার সুবাদে জীবিত প্রতিটি শিশুর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। ধন্যবাদ। ধন্যবাদ।
আসুন সবার জন্য দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করি । #LongLifeForAll