এবার ঈদে রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয় গত শনিবার; অর্ধেক টিকেট বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে, বাকিগুলো বিক্রি হচ্ছে ঢাকার চার স্টেশনে।
প্রথম দিনই টিকেট বিক্রির শুরুর সময় সকাল ৮টায় ই-টিকেটিং ওয়েবসাইটে ঢুকতে না পারার কথা জানাচ্ছেন যাত্রীরা। এক ঘণ্টা পর ওয়েবসাইট স্বাভাবিক হলেও ততক্ষণে অনলাইনের টিকেট শেষ। রোববার ও সোমবারের চিত্রও ছিল একই।
২৮ এপ্রিল রাজশাহী যাওয়ার জন্য রোববার ট্রেনের অনলাইনে টিকেট কাটার চেষ্টা করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহপরান ইসলাম। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে চেষ্টা করেও ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারেননি তিনি।
সোমবার তার সঙ্গে কথা হয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টারে, অগ্রিম টিকেট কাটার লাইনে।
শাহপরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “আমার বাড়ি যাওয়ার দরকার ছিল ২৮ তারিখ। রোববার সকাল থেকে অনলাইনে চেষ্টা করে কোনো টিকেট পেলাম না। অগত্যা ২৯ তারিখের ট্রেনের জন্য ভোর ৫টা থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বসে বেলা ১টায় একটা টিকেট ম্যানেজ করতে পেরেছি।”
রেলযাত্রীদের ফেইসবুক গ্রুপ ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান গ্রুপে’ গিয়ে দেখা গেল, অনলাইনে ট্রেনের টিকেট না পাওয়া যাত্রীদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে পোস্ট দিয়েছেন।
তাদের বেশির ভাগেরই অভিযোগ, সকাল থেকে এক-দেড়ঘণ্টা ওয়েবসাইটেই ঢোকা যায় না। কিছুক্ষণ পর প্রবেশ করা গেলেও দেখা যায় প্রায় সব টিকেট শেষ।
সোমবার সকালে ই-টিকেটিং সাইটে ঢুকতে না পেরে গ্রুপে পোস্ট দেন এস এম গিয়াসউদ্দিন। তিনি লিখেন, “সকাল পৌনে আটটা থেকেই চেষ্টা করছি সাইটে ঢোকার। ঢুকতে পেরেছি বেলা ১১টায়। তখন গিয়ে দেখি সব টিকেট শেষ। তাহলে কারা ঢুকতে পারল? কারাই বা টিকেট পেল?”
তবে অনলাইনে টিকেট কাটতে পেরে কয়েকজনকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে পোস্ট দিতেও দেখা গেছে।
কাউসার ফেরদৌস লিখেছেন, “মোবাইল থেকে লগইন করার চেয়ে ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ থেকে সার্ভারে (ওয়েবসাইটে) ঢোকা সহজ। আজকে (সোমবার) সকাল পৌনে ৯টায় ঢুকেই ২৯ তারিখের চট্টগ্রামের সুবর্ণ এক্সপ্রেসের টিকেট কাটতে পারলাম। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি টিকেট পেয়েছি।”
‘বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিবার’ ফেইসবুক গ্রুপে একজন আবার লিখেছেন, সকাল ৮টা থেকে টিকেট বিক্রির কথা থাকলেও তিনি কৌতূহলে ওয়েবসাইটে ঢুকে ভোর সোয়া ৫টায়ই টিকেট পেয়ে গেছেন।
কীভাবে টিকেট পেলেন, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি।
যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে সহজ ডটকমের জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক ফারহাত আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সার্ভারে ঢোকাই যাচ্ছে না- এই অভিযোগ আসলে ভুল। আমরা শুরু থেকেই সার্ভার যাতে ডাউন না হয়, সেজন্য এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, যাতে কিউ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটা সহজ হয়৷ প্রথমদিন অনলাইনে প্রতি মিনিটে পাঁচলাখ লোকের হিট ছিল। রোববার ১০ লাখ এবং সোমবার মিনিটে ১৮ লাখ হিট হয়েছে।”
যাত্রীরা যে টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ করছে, সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেখুন টিকেট মজুদ কম। মানে ১৩ হাজারের (দিনে) মতো টিকেট অনলাইনে বিক্রি জন্য আছে। প্রথম দিন যখন মানুষ ঈদের টিকেট কেনার জন্য ওয়েবসাইটে ঢুকলো তখন হিট ছিল ৫ লাখ। তাহলে প্রথম ১৩ হাজার মানুষ টিকেট পেয়ে গেছে। এরপরে যারা আছে, তারা পায়নি। এখানে আমাদের সহজের কোনো দোষ না। প্রতিদিনের অনলাইনে বরাদ্দ যখন শেষ হয়ে যায়, তখন তো আর টিকেট পাওয়া যায় না।”
সোমবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বেশ কয়েকজনকে পাওয়া গেল, যারা আগের দিন অনলাইনে টিকেট কাটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখানে এসেছেন।
তাদের একজন শেখ ইমদাদুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবার এবং রোববার দুইদিনই অনলাইনে টিকেটের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। না পেয়ে সোমবার ভোররাত থেকে এসে এইখানে বসে থাকার পর ২৯ তারিখ খুলনা যাওয়ার জন্য টিকেট পেয়েছি।
“রোববার রাত থেকেই এখানে যাত্রীরা অপেক্ষা করছে। কী অবস্থা একবার চিন্তা করেন! রাতে এসে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো টিকেট পাচ্ছে দুপুরে। কাউন্টারে গিয়ে প্রত্যেকটা যাত্রীকে কাগজপত্র দেখাতে হচ্ছে। সেগুলো চেক করে তাদের টিকেট দেওয়া হচ্ছে। তাই যাত্রীদের লাইন ক্লিয়ার হতে সময় নিচ্ছে বেশি।”
আবার স্টেশনে এসেও দীর্ঘ লাইনের কারণে দুপুর নাগাদ টিকেট পাননি অনেক যাত্রী। অনেকে অভিযোগ করছেন, টিকেট কাটতে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখানোর জন্য বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে দুই বছর পর মানুষ ঈদে বাড়িতে যাচ্ছে। তাই এবার যাত্রীদের মাঝে উৎকণ্ঠা একটু বেশিই। আর সেইজন্যই কাউন্টারগুলোতে টিকেটপ্রত্যাশীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
“যাত্রীদের স্বার্থেই টিকেট কালোবাজারি বন্ধ করতে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মসনদ দেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যাত্রীদেরও ধৈর্য ধরে আমাদের সাহায্য করতে হবে।”
পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করে কালোবাজারি বন্ধের আশা করছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। সোমবার দুপুরে কমলাপুর স্টেশন পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, “আজকের টিকিট নিয়ে তো কারো কোনো অভিযোগ নেই। কারণ আমরা তো সিস্টেম করেছি, অন্য কোনো জালিয়াতির সুযোগ নেই। আপনি আইডেনটিটি কার্ড দিয়ে টিকিট কাটবেন, আপনার টিকিট দিয়ে আমি যেতে পারব না।”
এত কিছুর পরও ঈদযাত্রায় ট্রেন টিকেট নিয়ে ভোগান্তির চিত্র পাল্টাচ্ছে না কেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মানুষের চাহিদার তুলনায় আমাদের ট্রেনের সংখ্যা কম। প্রতিদিন ৫০ লাখ লোক যাতায়াত করবে। রাস্তার সক্ষমতা হল মাত্র ১৫ লাখ।
“আমাদের রেলের সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা টিকিট বিক্রি করছি। সবাই টিকিট পাবে না। ৫ লাখ লোক যদি যেতে চায়, সেখানে আমি দিতে পারি ২০ হাজার।”
সোমবার দুপুরে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শনে গেলে টিকেট কাউন্টারগুলো ঘুরে দেখার পর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। তখন নানা ভোগান্তির পাশাপাশি টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা।
যাত্রীদের অভিযোগ নিয়ে সাংবাদিকরাও প্রশ্ন করেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনকে। ভিড় নিয়ে তিনি বলেন, “কালকের টিকিটের জন্য যদি লোকজন আজকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে আমাদের কী করার আছে বলেন?
কালোবাজারির অভিযোগ নিয়ে মন্ত্রী বলেন, “কালোবাজারি কীভাবে করবে? আমি যদি আপনার টিকিটে না যেতে পারি, তো টিকেট নিয়ে কী করব? একজন চারজনের টিকেট নিলে চারজনের আইডি কার্ডই জমা দিতে হবে।”
ই-টিকেটিংয়ের নতুন সার্ভিস প্রোভাইডার সহজ, সিনেসিস ও ভিনসেন জয়েন্ট ভেঞ্চার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অনলাইনে টিকেট পেতে ভোগান্তির যে অভিযোগ আসছে, সে বিষয়েও মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে তিনি এই সময়ে চাহিদার তুলনায় ট্রেন কম থাকার কথাই বলেন।