বিখ্যাত কান্তজী মন্দির, রামসাগর আর নয়নাভিরাম শালবন দেখে ভালোই কাটে দিনগুলো। কাটারিভোগ চালের ভাতের সঙ্গে রুস্তম হোটেলের
গরুর মাংস ভুনা, মুন্সির হোটেলের খাসি আর
ভাবির হোটেলের টাকিভর্তার অন্যরকম স্বাদ নিয়েছি বারকয়েক।
শহরের একটু বাইরে বটতলীতে মালেকের চায়ের দোকান। মালাইয়ের চা খেতে খেতে ভাটিনা গ্রামের
কথা শুনি। নানা জাতের অনেক পাখি সেখানে। না দেখে চলে যেতে মন চাইল না। দুপুরের পর শামীমকে নিয়ে রওনা হই আমরা।
দিনাজপুর শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। চিরিরবন্দরের রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়ে
একটি বেইলি ব্রিজ ঠেকলো। ব্রিজে উঠে শামীম জানাল এটি গর্ভেশ্বরী নদী। এখন শুকিয়ে গেলেও একসময় নাকি এর গর্ভ
স্পর্শ করা অসম্ভব ছিল। ব্রিজ পেরিয়ে মাস্তান বাজার। দেশের সবচেয়ে বড় টমেটোর বাজার এটি। রাস্তার পাশেই টমেটো নিয়ে চলছে কৃষকদের
দর কষাকষি।
বাজারের বাঁ দিক দিয়ে ইট বিছানো পথ চলে গেছে ভাটিনায়। দুপাশে লিচু আর আমের বাগান। ঝাঁকড়া চুলের লিচুগাছগুলো দেখতে বেশ। অল্প সময়ে পৌঁছে যাই গর্ভেশ্বরীর তীর
ঘেষা উঁচু বাধের ওপর। পাশেই শ্মশান। সেখানে চোখ পড়তেই গা ছমছম করে ওঠে। কালীপূজার মেলা বসেছে দূরে। সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন তোদের
মাঝারে’।
ছবি: লেখক
গানে ভেসে দুই রাস্তার মাথায় এসে দাঁড়াই। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধানক্ষেত। ভারি বাতাস সবুজ জমিনে ঢেউ তুলে ছুটে
যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ কৃষককে জিজ্ঞেস করে মেঠোপথ ধরে এগোতে গিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে লেখা ‘পাখি সংরক্ষিত এলাকা, পাখি মারা নিষেধ’। বুঝতে পারি এসে গেছি ভাটিনায়।
ঢুকে পড়লাম গ্রামটিতে। ভাটিনার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়ার
মতো বাঁশঝাড়। সারা গ্রামেই রয়েছে ছোট ছোট পুকুর। পুকুরগুলো বাঁশ আর আমগাছে ঘেরা। একটি বড় পুকুর পেরিয়ে যতই এগুচ্ছি ততই
শত শত পাখির কিচিরমিচির শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। সামনে আসতেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি খানিকক্ষণ। একটি বাঁশবাগানের প্রায় প্রতিটি ডালেই
নানা জাতের শত শত পাখি। মনের আনন্দে সকলেই চেঁচাচ্ছে। এ যেন পাখির মহামিলনস্থল। মনের ভেতর এক অন্যরকম ভালো লাগা টের পেলাম। এ এক অন্যরকম মন জুড়ানো দৃশ্য।
অন্য পাশের আরেকটি বাঁশঝাড়ে বসেছে অজস্র কালো পানকৌড়ি। চোখের সামনেই কয়েকটি পানকৌড়ি পানিতে ডুবে
ঠোঁট দিয়ে ধরে আনল বেশ কয়েকটি মাছ। একটি দেশি শালিককে দেখা গেল বড় একটি পানকৌড়িকে ঠোকর দিতে পিছু
নিয়েছে। এত পাখি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। দেখার আনন্দে ছটফট করতে লাগলাম।
ছোট্ট একটি পুকুরের চারদিকের গাছগুলোতে অজস্র বক আকৃতির এক ধরনের
বাদামি রঙের পাখি দেখা গেল। চোখ বন্ধ করে বেশ আয়েশী কায়দায় শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে তারা। পেছন থেকে একজন জানাল, এরা রাতচোরা। হয়ত এ কারণে চোরদের মতো দিনে ঘুমাচ্ছে। পাখি ওড়াতে একজন বিশেষ কায়দায় শব্দ করতেই
বিস্ময়কর এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। হাজার হাজার পাখি গাছ থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে চলল। মনেই হয়নি গাছগুলোতে এত পাখি ছিল। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। মাথার ওপর আকাশের সবখানেই হাজার হাজার
পাখি উড়ছে। মনে হচ্ছে ক্রমেই আকাশ থেকে পাখিদের একটি বড় জাল আমাদের ঢেকে দেবে।
ভাটিনা গ্রামের লোকেরা এরকম মনজুড়ানো দৃশ্য দেখে প্রতিদিন। শত শত পানকৌড়ি, সাদা বক, কুনি বক, গুটকল, রাতচোরা, ঘুঘু, শালিক, টিয়া আর ময়নার ভয়হীন অবাধ
আনাগোনা চলে গ্রামটিতে। কাদের মহতি উদ্যোগে তৈরি হয়েছে পাখিদের এমন প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য? স্থানীয় লোকেরা এক বাক্যে
জানাল ‘আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতির’ কথা।
ছবি: লেখক
১৯৯৬ সাল। ভাটিনা গ্রামের লোকেরা তখন ছিল খানিকটা
শিক্ষাবিমুখ। পরিবেশগত কারণে গোটা গ্রামেই ছিল পাখির আনাগোনা। ফাঁদ পেতে বক ও পাখি ধরাই ছিল গ্রামবাসীর
দৈনন্দিন ব্যাপার। এছাড়া গ্রামটিতে বিত্তশালীদের এয়ার গান আর বন্দুকের শব্দ চলত প্রায় সারাদিন। দিন শেষে একঝাঁক মৃত পাখির দেহ ঝুলতে
থাকত শিকারিদের মোটরসাইকেলে।
গ্রামের কলেজ পড়ুয়া একরামুল হক থাকেন খালার বাড়িতে। নিজেদের ভাগ্য গড়া আর গ্রামের জন্য কাজ
করার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন যুবকদের মাঝে। অল্প সময়ে তৈরি হয় ‘আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতি’। প্রথমে ২৫টি পরিবার থেকে শিক্ষাবৃত্তির জন্য প্রতি সপ্তাহে সংগ্রহ করা হয় ১ টাকা করে। তার সঙ্গে অন্য সদস্যদের সঞ্চয় দিয়ে চলে
শিক্ষা কার্যক্রম। যুবকদের এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় মেম্বার ও মুক্তিযোদ্ধা হাশেম
তালুকদার। মূলত তার সম্পৃক্ততার কারণেই সমিতিটি সহজেই গোটা গ্রামে আলো ছড়িয়ে দিতে থাকে। অল্প সময়েই ‘আলোর ভুবন সমিতি’ মানুষের মনে জায়গা করে নেয়।
কয়েক মাস কেটে যেতেই সমিতির সভাপতি একরামুল প্রস্তাব করেন গোটা
গ্রামটিতে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করার। প্রথমেই পাখি না মারার প্রস্তাবে সম্মতি দেন হাশেম তালুকদার
নিজেই। পাখি মারার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছেড়ে নিজের এয়ারগানটি ছুড়ে ফেলে দেন। শপথ নেন পাখি না মারার। সেই থেকে শুরু। গ্রামের প্রভাবশালী হওয়ায় অন্যরাও অনুসরণ
করে তাকে। গোটা গ্রামবাসী মেতে ওঠে পাখিপ্রেমে।
পরিকল্পনা মোতাবেক ভাটিনায় ঢোকার তিনটি প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়া
হয় ‘পাখি মারা নিষেধ’ লিখিত বড় সাইনবোর্ড। গ্রামবাসীর ভালোবাসায় ক্রমেই বদলে যায় ভাটিনা গ্রামটি।
দিনাজপুর শহর থেকে আসা ইমরান জানায় তার অভিজ্ঞতার কথা। একবার সাইনবোর্ডের নির্দেশকে উপেক্ষা
করে পাখি মারতে ইমরান ঢোকে ভাটিনা গ্রামে। পাখি মারার অপরাধে গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়ে ও নারীরাসহ সবাই তাকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখে। ভবিষ্যতে পাখি না মারার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পায় সে। এরপর থেকে ইমরান আর পাখি শিকার করে না। পেছনের কথা মনে হলে পাখি হত্যার অপরাধে
আজও তিনি লজ্জিত হন।
ছবি: লেখক
ভাটিনা গ্রামটি সারা বছরই থাকে নানা ফসলে ভরপুর। টমেটো আবাদ হয় শত শত একর জমিতে। টমেটো চাষি মনসুর বলেন, সাধারণত টমেটো ক্ষেতে পোকার
উপদ্রব এত বেশি হয় যে কীটনাশক ছিটিয়েও তা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। কিন্ত ভাটিনা গ্রামের শত শত পাখি ওইসব
পোকা খেয়ে ফেলে। ফলে কীটনাশক ছাড়াই পোকা দমন হয়। এ কারণে এখানকার কৃষকরা টমেটো ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি গেড়ে পাখিদের
বসার বিশেষ ব্যবস্থা করে রাখে। তাছাড়া পাখি থাকার কারণে ধানক্ষেতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ নেই
বললেই চলে। কীটনাশক নয়, পাখির মাধ্যমে পোকার উপদ্রব
কমানোর পদ্ধতি এটি। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে খেয়ে ফেলে সব পোকা। এভাবেই ভাটিনা গ্রামে প্রকৃতিই বাঁচিয়ে
রাখে প্রকৃতিকে।
আলোর ভুবন সমিতির পরিকল্পনার কথা শোনান সমিতির সাধারণ সম্পাদক
রেজাউল ইসলাম। পাখিদের খাদ্যের কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে সমিতির উদ্যোগে গ্রামের রাস্তার পাশে
লাগানো হয়েছে প্রায় তিনশ বট ও পাকুড় গাছ। এছাড়া অন্যান্য গ্রামেও পাখি শিকার বন্ধ করতে সমিতি প্রতি শুক্রবার
মসজিদে মসজিদে সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পাঁচটি পুকুর নিয়ে মাছচাষ প্রকল্প এবং
একটি লেয়ার মুরগির ফার্মসহ বিভিন্ন আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প থাকলেও সমিতির সদস্যরা মনে
করেন পাখি রক্ষার উদ্যোগটিই তাদের ব্যাপক পরিচিতি ঘটিয়েছে, করেছে সম্মানিত।
পাখিদের সঙ্গে গ্রামবাসীর গড়ে উঠেছে আত্মার সম্পর্ক। ঝড়ের পর পরই ভাটিনাবাসী বেরিয়ে পড়ে কুলা
হাতে। খুঁজে খুঁজে বের করে ঝড়ে আহত পাখিগুলো। সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয় তাদের গন্তব্যে। ভাটিনা গ্রামে সকাল-সন্ধ্যা চলে পাখিদের অবাধ আনন্দ চিৎকার। ছুটির দিনে আশপাশের শত শত পাখিপ্রেমীর
পদধুলিতে ধন্য হয় গ্রামটি। অনেকের কাছে তাই ভাটিনা তাই ‘পাখিপ্রেমীদের গ্রাম’।
সবার স্বপ্ন একসময় ভাটিনাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে ‘পাখি মারা
নিষেধ’ সংশ্লিষ্ট সব সাইনবোর্ড উঠে যাবে। পাখির মতো একটি প্রাণীকে হত্যা করার কথা কারও চিন্তায়ও আসবে
না। ছোট শিশুরা বেড়ে উঠবে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে। পুঁথিগত শিক্ষা না পৌঁছালেও জীবের প্রতি
দয়ার মহত্ব নিয়ে বেড়ে উঠবে শিশুরা। সবার মনে পাখির প্রতি থাকবে মমতাবোধ ও ভালোবাসা।
সূর্য ডুবছে ভাটিনায়। দূর-দুরান্ত থেকে ফিরে আসছে হাজার হাজার পাখি। পুকুরে ঝাঁপিয়ে দিনশেষের ক্লান্তি দূর
করছে কেউ কেউ। চলছে বক-পাখিদের ডুবসাঁতার। পাখিদের এসব দৃশ্য দেখলে কে আর ফিরতে
চায়! পাখিপ্রেমিদের গ্রাম ভাটিনার
কথা মনে হলে আজও উদাস হয়ে যাই।
কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |