ক্যাটাগরি

ফিলিপিনো আন্ডারওয়াটার পার্ক

সাগর তো দূরের কথা ছোট একটা পুকুরের তলের জগতই এক রহস্য এখনও আমার কাছে। ডুবসাঁতার তো দেওয়া যায়, কিন্তু কতক্ষণ আর দম আটকে মাছ আর জলজ উদ্ভিদের চরাচর দেখার সুযোগ মেলে। আর সাগরের নিচের জগৎ তো আরও দুর্ভেদ্য। কিন্তু এমন যদি হয় যে সাগরের নিচে যে অদ্ভুত রঙিন জগৎ রয়েছে তা হেঁটে হেঁটে, চিপস আর ক্যান্ডি খেতে খেতে দেখে নেওয়া যায়!

তখন আমি ছিলাম ম্যানিলায়। ম্যানিলা ফিলিপাইনের রাজধানী। আমাদের ঢাকা শহরের মতোই, তবে আরেকটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঢাকা থেকে ম্যানিলার দূরত্ব প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। ম্যানিলায় অনেককিছু দেখার আছে। পুরনো বাড়িঘর, গির্জা, মার্কেট, বিভিন্ন ধরনের পার্ক। পার্ক বলতে শুধু গাছপালা আছে আর হাঁটার বা বসার ব্যবস্থা আছে তা নয়। আমি এমন এক পার্কে গিয়েছি যা সাগরতলের পরিবেশ মনে করিয়ে দেয়। পুকুরের মাছ যেখানে সাঁতার কাটার সময় অতিকষ্টে দেখতে পাওয়া যায় সেখানে বিশাল এই পার্কে সাগরের সমস্ত ছোট-বড় মাছ আমার সামনে পেছনে ডানে বায়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ এক রহস্যময় নতুন জগৎ।

এই পার্কের নাম ‘ম্যানিলা ওশেন পার্ক’। ফিলিপাইন দেশটা প্রশান্ত সাগরের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ মিলিয়ে তৈরি হয়েছে। তাই দেশটিতে সামুদ্রিক মাছ বা উদ্ভিদের কমতি নেই, কমতি নেই বিস্ময়ের।

ওশেন পার্কের ভেতরে ঢোকার আগেই অনেক গাছপালা দিয়ে একটা সুন্দর বনের মতো করে রাখা আছে৷ বড় বড় গাছের উঁচু ডাল থেকে লতা বেয়ে নিচে নামছে আর এই বনের জায়গায় জায়গায় বিশাল অ্যাক্যুরিয়ামে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট, মাঝারি আকারের মাছ রাখা। মাছেরা মনের আনন্দে খেলছে। নেচে বেড়াচ্ছে উপর নিচে।

ওশেন পার্কের ভেতরে ঢুকতেই একটি আধো অন্ধকার বড় ঘরের মাঝে এসে পড়লাম। মাথার উপর জ্বলছে কৃত্রিম আলো, তাও খুব উজ্জ্বল নয়। নিজের হাত পা আর সামনের মানুষ ছাড়া দূরের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পার্কের কর্মীরা আমাকে পথ দেখিয়ে দিল কোন দিকে যেতে হবে। প্রথমে যে কক্ষে গেলাম তার দেয়াল জুড়ে ছাদ অবধি বিশাল আকারের স্বচ্ছ অ্যাক্যুরিয়ামে ছোট ছোট রঙিন মাছ রাখা। মাছেরা লাল, নীল, হলুদ, কমলা, সবুজ কত না রঙে তিরতির করে সাতরাচ্ছে উপরে আর নিচে।

আমি সাগরের এই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীদের বেশিরভাগেরই নাম জানি না। অনেকেই জানে না। একেকটা নামও অদ্ভুত – টিকোস, হোয়াইট সারডিন, বাংগুস মিল্কফিশ, ক্যাটফিশ, পোনিফিশ, ড্রাগোনেট। নাম যাই হোক না কেন ছোট আর মাঝারি আকারের রঙিন মাছগুলো এত আদুরে যে বাসায় নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার বাসায়ও একটা অ্যাক্যুরিয়াম ছিল, কিছু পরিচিত মাছ ছিল, কিন্তু এত রকমের সামুদ্রিক মাছ যারা নিজেদের রঙের মাঝে খেলা করে যাচ্ছে তাদের কাছ থেকেও সরতে ইচ্ছে করছে না।

এই ওশেন পার্কে নাকি ১৪ হাজার সামুদ্রিক প্রাণী জায়গা করে নিয়েছে। আমি তো মাত্র ১০/১২টা দেখলাম। বাকিগুলো দেখব কখন! কয়েকদিন লাগবে দেখতে নিশ্চয়ই। একটু একটু এগিয়ে সামনের কক্ষে গিয়ে মনে হলো আমি গভীর সাগরের তলার বালিতে হেঁটে বেড়াচ্ছি। বিশাল কক্ষের চারদিকে কাচের দেয়াল আর দেয়ালের অপরপাশে বিভিন্ন রঙের বিশাল বিশাল মাছ হেলেদুলে লেজ নাড়িয়ে বা কখনও ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ঠিক যেন আসল সমুদ্রের নিজস্ব জগত। পর পর কয়েকটা কক্ষ একই রকম বিশাল আর সাগরের মাছেদের বাড়িঘর।

এর মাঝে দেখি একজন ডুবুরির পোশাক পরে মাছদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এপাশে ডাঙায় আমাদের মতো দর্শনার্থীদের দেখে হাত নাড়ছেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কর্মীকে বললাম, আমিও এরকম স্কুবা ডাইভিং করতে চাই। কিন্তু তিনি জানালেন যে এটা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। যিনি ভেতরে মাছদের সাথে আছেন তিনি এক্সপার্ট এবং মাছের ডাক্তার। মাছদের ভালোমন্দ দেখার জন্য তিনি এখন জলে বিচরণ করছেন। আমার কিন্তু দারুণ লেগেছে ব্যাপারটা। এত কাছ থেকে সমুদ্রের গভীরের মাছ দেখতে পাব ভাবতেই পারিনি।

এই সমুদ্র জগতে সবকিছুই জলের মতো নির্মল। হেঁটে হেঁটে সামনে এগোনোর পর দেখি আস্ত সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। এতক্ষণ কক্ষের চারপাশে সমুদ্র আর মাছেরা খেলা করছিল এখন তো ডানে বামে, মাথার উপর জল আর মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে তাও আবার বিশালাকৃতির মাছ সব। এই জায়গাটাকে একটা কাচের লম্বা টানেলের মতো করে দেওয়া আছে যাতে একেবারে গভীর সমুদ্রের ভেতরের রহস্য আমরা দেখে ফেলতে পারি, অনুভব করতে পারি। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এখানেই আমি স্বচ্ছ জলে সাঁতরে বেড়ানো হাঙর দেখলাম। কী আনন্দ! এরা সামনের দাঁত বের করে, একটু হা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ কে বলবে স্থল থেকে আমরা এদেরকে কতই না ভয়ংকর ভাবি।

এই টানেলে প্রায় সব মাছই বিশাল। কয়েকটা ছাইরঙা পিরানহা মাছ দেখলাম নীল জলে ঘুরছে, দেখে খুব শান্ত বলে মনে হল। আসলে কি তাই! আমার সত্যি এই গভীর সমুদ্রে চলে যেতে ইচ্ছে করছে, কাছ থেকে মাছদের এই ঘুরে বেড়ানো দেখা আর মাছদের ছুঁয়ে দেখার আলাদা রোমাঞ্চ আছে। কিন্তু কিছু মাছ তো ভয়ঙ্কর হয় অন্য প্রাণীর জন্য আর যারা এক্সপার্ট তাদেরই গভীর সমুদ্রে যাবার অনুমতি আছে।

এখানে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের বেশিরভাগই শিশু ও কিশোর। এরা এত আনন্দ পাচ্ছে জলের নিচের জগৎ থেকে যে মাছেরাও আরও বেশি নেচে নেচে চলে যাচ্ছে এদের সামনে দিয়ে। কেউ কেউ তো কাচের দেয়ালের গা ঘেঁষে বসেই পড়েছে এপাশ থেকে মাছদের ছুঁয়ে দেখার জন্য। মাছরাও আসে, দু-একবার বাচ্চাদের হাতে ঠোকর দেয়, তারপর চলে যায়।

টানেল থেকে বের হতে ইচ্ছে করছিলো না। মনে হচ্ছিল ঘুরে বেড়াই সমুদ্রের এই অজানা, অচেনা পাতালপুরীতে। পরের কক্ষে চারদিকের দেয়াল সমান অ্যাক্যুরিয়ামে রাখা আছে সামুদ্রিক সরীসৃপ এই যেমন কচ্ছপ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ইগুয়ানা, মেসোসারাস ইত্যাদি। প্রত্যেক প্রাণীর রঙ প্রায় একই – ধূসর। আগের কক্ষগুলোতে এত সুন্দর সুন্দর মাছ দেখে এসেছি যে জলে সাঁতরে বেড়ানো কচ্ছপ বা কিলবিল করে ওঠা সাপ দেখতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও সাপ, কচ্ছপের যে এত প্রজাতি আছে তা এখানে না আসলে জানতামই না।

পরের সেকশন দখল করে আছে মিষ্টি পেঙ্গুইন বন্ধুরা। পেঙ্গুইন শীতের দেশে প্রাণী। তাই এখানেও বিশাল জায়গায় বরফ দিয়ে, রুমের তাপমাত্রা কমিয়ে পেঙ্গুইনদের বসবাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। জল ছাড়া পেঙ্গুইনের চলেই না। তাই বরফের মাঝে একটি ছোট লেক মতো রাখা হয়েছে। সেখানে সারি সারি পেঙ্গুইন এক এক করে ঝুপ ঝুপ নেমে সাঁতারে বেড়াচ্ছে। এরা প্রত্যেকেই দেখতে হ্যাপি ফিট আর পেঙ্গুইনস ম্যুভির একেকটা চরিত্রের মতো। লাফিয়ে, গড়িয়ে বেড়াচ্ছে ওদের মনের মতোই সাদা বরফের গায়ে, বরফ উড়িয়ে, নিজেদের সাদা-কালো চকচকে আদুরে শরীর দুলিয়ে। এরা এখানেও মুক্ত স্বাধীন। কোন খাঁচায় আটকে রাখা হয়নি। আমরা দূর থেকে দেখে, এদের খেলাধুলায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চলে যেতে পারি।

পরের বিশাল কক্ষে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনের কিছুই দেখা যায় না, আসলেই মনে হচ্ছে সমুদ্রের একদম নিচে এসে পৌঁছেছি যেখানে সূর্যের আলো মোটেও যেতে পারে না। হাঁটতে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারি আবার একটু ভয় ভয়ও করছে, যদি হঠাৎ সমুদ্রের একরাশ পানি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়! এই বিল্ডিংয়ের পাশেই তো সমুদ্র। সামলাতে সামলাতে দেখি মেঝে থেকে ছাদ অবধি লম্বা লম্বা পিলারের মতো কাচের অ্যাক্যুরিয়াম। এমন অ্যাক্যুরিয়াম আগে দেখিনি। ভেতরে স্বচ্ছ পানি আর পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে নানা রঙের সামুদ্রিক জীব। এদের শরীর ঠিকরে বেরোচ্ছে আলোর ছটা, কারো গোলাপি, কারো নীল। কারা এরা? আমি এদের নিজের চোখে না দেখলে জানতামই না যে এরা এত সুন্দর! এরা বিভিন্ন প্রজাতির জেলিফিশ।

আমি জেলিফিশ আগে কখনও জলে সাঁতার কাটতে দেখিনি, আর জানতামও না যে অন্ধকারে এদের শরীর থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। সংকুচিত প্রসারিত হয়ে এরা জলে উপরে নিচে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। অন্ধকার বলে আলো ছড়াচ্ছে যেমন ছড়ায় সমুদ্রের একদম নিচের জগতে। আর তাইতো এ কক্ষে আলো রাখা হয়নি। এদের শরীরের আলোতেই আলোকিত হয়ে আছে আশপাশ।

পরের কক্ষে আরও অনেক প্রজাতির জেলিফিশ রাখা আর চারপাশের দেয়ালজুড়ে তারা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। কে বলবে দিনের বেলায় সাগরপাড়ের বালিতে কখনও সখনও আমরা যে স্বচ্ছ জেলিফিশ পড়ে থাকতে দেখি তা সমুদ্রের তলদেশে এত সৌন্দর্য আঁকড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

সমুদ্রের নিজস্ব জগৎ এত সুন্দর তা কাছে থেকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। সারাদিন পার করলাম সমুদ্রের এই পার্কে। আমার দেখার, জানার, আনন্দের নতুন নতুন দুয়ার খুলে দিল এই ওশেন পার্ক।

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com
সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!