ক্যাটাগরি

রিয়ালের ‘বেঞ্জামিন বাটন’ মদ্রিচ

ইউরোপ সেরার আসরে সেমি-ফাইনালের প্রথম লেগে মঙ্গলবার মুখোমুখি হবে সিটি ও রিয়াল মাদ্রিদ। বাংলাদেশ সময় রাত ১টা সিটির আঙিনা ইতিহাদ স্টেডিয়ামে শুরু হবে ম্যাচটি।

দুই দলেই তারকার কমতি নেই। তরুণ তুর্কি যেমন আছেন, অভিজ্ঞদের বহরও নাতিদীর্ঘ নয় মোটেও। কিন্তু সিটি কোচ পেপ গুয়ার্দিওলাকে একটু বেশিই ভাবতে হবে মদ্রিচকে নিয়ে। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার পেটানো শরীরের এই মিডফিল্ডার যে বয়সকে স্রেফ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছুটছেন। দলের প্রয়োজনের সময়ে সাঁড়া দিচ্ছেন নিয়মিত।

এই কাতারে আছেন করিম বেনজেমাও। ৩৪ বছর বয়সী এই ফরাসি স্ট্রাইকার এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পিএসজি ও চেলসির বিপক্ষে উপহার দিয়েছেন টানা দুই হ্যাটট্রিক। সাবেক ক্লাব সতীর্থ ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর ‘মিস্টার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ’- মুকুটের জোরাল দাবিদার এখন তিনি।

নিত্যই রিয়ালের গোলের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন বেনজেমা, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোণঠাসা দলকে ফেরাতে গড়ে দিচ্ছেন ব্যবধান। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রেকর্ড ১৩ বারের চ্যাম্পিয়নদের দুর্দান্ত পথচলায় তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেন মদ্রিচ। কেননা, কার্লো আনচেলত্তির ছকে দ্বৈত ভূমিকা এই ক্রোয়াটের। নিচ থেকে বল তৈরি করে দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের পেনাল্টি এরিয়ায় ভয়ঙ্কর পাসগুলো দিয়ে আক্রমণের সুর বেঁধে দেওয়া- দলের খেলার সমন্বয়ে গুরুভার তার কাঁধে সঁপে দিয়ে একরকম নিশ্চিত থাকেন রিয়াল কোচ।

এই মৌসুমেও সেটা অনেকবার সুচারুভাবে করে দেখিয়েছেন মদ্রিচ। চেলসির বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে দল যখন হারের শঙ্কায় তখন বক্সের বাইরে থেকে তার দুর্দান্ত অ্যাসিস্টে গোল করেছিলেন রদ্রিগো; তাতে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে এবং শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করে রিয়াল।

মদ্রিচের ওই দারুণ পাসকে রেঞ্জার্সের সাবেক স্ট্রাইকার অ্যালি ম্যাককোইস্ট উপমা দিয়েছিলেন, ‘পাস অব দা ডেকেড’। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক ডিফেন্ডার রিও ফার্ডিনান্ডের চোখে এ যেন ‘অবিশ্বাস্য কিছু, হতেই পারে না’; তাইতো বিস্ময়ভরা চোখে তিনি বলেন এটা ‘অবৈধ’। স্প্যানিশ দৈনিক মার্কা লিখেছিল, “মাঠে যখন মদ্রিচ, তখন কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এখনই তার একটা মূর্তি গড়া হোক।”

রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেস এর আগে প্রশংসায় ভাসিয়েছিলে মদ্রিচকে স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালের পারফরম্যান্সের জন্য। গত জানুয়ারিতে আথলেতিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে রিয়ালের ২-০ গোলের জয়ের ম্যাচে আলো ঝলমলে পারফর‌ম্যান্সের জন্য মদ্রিচকে আবারও ব্যালন ডি’অরের জন্য বিবেচনা করা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

মদ্রিচের দিকে এভাবে প্রসংশার স্রোত বয়ে যাওয়ার কারণ মূলত তার বয়স। কেননা ৩৬ বছর বয়সে ধারাবাহিকভাবে দুর্দান্ত পারফরম করে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

একই সঙ্গে মদ্রিচ এই বয়সেও কতটা প্রাণোচ্ছল এবং শারীরিক শক্তির অধিকারী, তা শেষ ষোলোয় পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচ শেষে তার বুনো উদযাপনেও ফুটে ওঠে। ফিরতি লেগের ওই অবিশ্বাস্য জয়ের পর ড্রেসিং রুমে ঢোকার আগে স্ট্যান্ড ধরে জিমন্যাস্টদের মতো ডিগবাজি দেওয়ার ভঙ্গি করেছিলেন মদ্রিচ।

ওই ম্যাচে প্রায় ১০ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার দৌড়ে ছিলেন তিনি, যেটা রিয়ালের যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি! তারপরও ড্রেসিং রূমের ঢোকার আগ মুহূর্তে তার অমন ভঙ্গি এবং সতীর্থেদের সঙ্গে বাধভাঙা উদযাপনে তার শারীরিক সক্ষমতা, অফুরান প্রাণশক্তির প্রমাণ মেলে।

কেবল কী প্রশংসা? ‘বয়সী’ মদ্রিচকে নিয়ে মজাও করা হয় রিয়ালের ড্রেসিংরুমে! সেখানেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কমতি হয় না কখনও। ক্লাব সতীর্থ রদ্রিগোর বাবার চেয়ে মদ্রিচের বয়স মাত্র এক বছর কম। দুই সতীর্থকে অনেকে ‘বাবা-ছেলে’ বলেও মজা করেন। এমনকি গত মাসে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মদ্রিচকে ‘ফাদার্স ডে’তে শুভকামনাও জানিয়েছিলেন রদ্রিগো।

স্পেনের গণমাধ্যমও মদ্রিচের প্রশংসায় সরব। গত মৌসুমেই স্প্যানিশ দৈনিক এএস তারকা এই মিডফিল্ডারকে বর্ণনা করেছিল ‘বেঞ্জামিন বাটন’ হিসাবে। ‘কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন’-ব্র্যাড পিট অভিনীত এই সিনেমায় দেখানো হয় প্রাকৃতিক নিয়মের উল্টো কিছু। বুড়ো হয়ে জন্ম নেওয়া শিশুটির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারুণ্য ফিরতে থাকে। বাড়তে থাকে কর্মস্পৃহা, প্রাণশক্তি সবকিছু। ফুটবলার মদ্রিচের ক্ষেত্রেও যেন তেমনই হচ্ছে।

গত মৌসুমে রিয়াল ও ক্রোয়েশিয়ার হয়ে ৫৭টি ম্যাচ খেলেন তিনি, যার ৩৩টিতে খেলেন পুরো ৯০ মিনিট। সিনেমার ঘটনায় অবিশ্বাসের টানাপোড়েন থাকতে পারে, কিন্তু মদ্রিচকে নিয়ে নয়।

এবং বিস্ময়কর হলেও সত্যি মদ্রিচের গতি কমেনি। এই মৌসুমে তিনি ৪৪ ম্যাচ খেলেছেন এবং তার ক্ষুরধার পারফরম্যান্স, নিবেদন এই ধারণার জন্মই দিয়েছে-তিনি খেলে যেতে পারবেন ৪০ বছর বয়সেও। সাম্প্রতিক সময়ে এএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মদ্রিচের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা ক্রোয়েশিয়ার ফিটনেস বিশেষজ্ঞ ভ্লাতকো ভুচেতিচের কথায়ও উঠেছিল বিষয়টি। তিনিও বলেছিলেন, মদ্রিচের খেলা চল্লিশেও চালসে হবে না!

অতদিন মদ্রিচ খেলা চালিয়ে যাবেন কিনা, কিংবা চালিয়ে গেলেও রিয়ালের জার্সিতে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর আপাতত সময়ের হাতে তোলা থাকছে। কিন্তু বর্তমানেই তিনি রিয়ালের হয়ে লিখে ফেলেছেন অনেক কিছু। তাই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে, মাদ্রিদের দলটির সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডার তিনি কি-না?

২০১২ সালে টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার পর প্রথম মৌসুম তার ভালো কাটেনি। সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে সেসময়কার কোচ জোসে মরিনিয়োর সময়টাও ছিল ভীষণ টালমাটাল। কিন্তু ২০১৩ সালে আনচেলত্তি দলটির হাল ধরার পর খোলনলচে পাল্টে যায়। মদ্রিচ হয়ে ওঠেন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।

২০১৩-১৪ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেই ছাপ রাখেন মদ্রিচ। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে তার নিখুঁত কর্নার থেকেই রিয়ালকে সমতায় ফেরান সের্হিও রামোস। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে আতলেতিকো মাদ্রিদকে ৪-১ ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা উৎসব সারে রিয়াল। ক্লাবটির ইতিহাসে সেটি ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দশম শিরোপা। এক যুগের অপেক্ষা ফুরানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তও।

এরপর থেকে রিয়ালে মাঝমাঠের অপরিহার্য সেনানী মদ্রিচ। ছুটছেন তো ছুটছেনই। প্রতি ম্যাচে মাঝমাঠে সুর বেঁধে দিচ্ছেন বয়সের ভারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে। আসছে ম্যাচে সিটি কোচ গুয়ার্দিওলার ছকে বাড়তি গুরুত্বই পাবেন ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর মদ্রিচ’।