ক্যাটাগরি

মন্দা কাটলেও কারিগর সংকটে চাপ দর্জিপাড়ায়

আগের বছরগুলোর মতই এবার ঈদের আগে প্রচুর অর্ডার এসেছে, কিন্তু কারিগরের অভাবে অনেক কাজ নিতে পারেননি কাটিং মাস্টার ও দোকান মালিকরা।

টেইলার্স মালিকরা বলছেন, গত দুই বছরে কোভিডের কারণে সেলাইয়ের কাজ চুকিয়ে অনেক কারিগর পেশা পরিবর্তন করেছেন। ফলে মহামারীর ধাক্কা কিছুটা সামলে উঠলেও পুরনো ছন্দ ফেরেনি পুরোপুরি।

ঈদে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পোশাক ডেলিভারি দেওয়ার তাগাদা থাকায় বেশি অর্ডার নেওয়া যাচ্ছে না। টেইলার্সে গিয়ে ফিরে আসছেন অনেক গ্রাহক। বেসরকারি চাকুরে কাশফিয়া তেমনই একজন।

বনানী সুপার মার্কেটে সোমবার সালোয়ার-কামিজ বানানোর অর্ডার দিতে গিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে।

“দশ রোজার পর থেকে সাধারণত কাপড় নেয় না আর। তারপরও এসেছিলাম, যদি বানিয়ে দেয়। আমার পরিচিত দোকান বলল, এখন বানালে তাড়াহুড়ায় জামা ভালো হবে না। ঈদের পরে দিতে। তাই আর বানালাম না।”

অনেক দর্জি দোকানে আবার বাড়তি টাকা দিয়ে পোশাক তৈরি করা যাচ্ছে।

নিউ মার্কেট থেকে থ্রি-পিস কিনেছেন জেরিন জান্নাত। কয়েকটি টেইলার্স কাপড় ফেরত দিলেও মিরপুরের আধুনিক টেইলার্স তার অর্ডার নিয়েছে।

জেরিন বলেন, “আমাকে বলল, ড্রেস বানায় দিতে পারবে কিন্তু মজুরি নিবে ডাবল। পরে বলে-কয়ে কিছু কমিয়ে দিয়ে এলাম। কি আর করা, ঈদে এমনিতেই ওরা মজুরি বাড়িয়ে দেয়।” 

কাজ প্রচুর, নেই কারিগর

ঢাকার মিরপুর, নিউ মার্কেট, এলিফেন্ট রোড ও বনানী ঘুরে দেখা যায়, গত দুই বছর ঈদে অনেকটা নীরব থাকা দর্জির দোকানগুলোতে এবার দম ফেলার সুযোগ পাচ্ছেন না কাটিং মাস্টার ও কারিগররা। আগে থেকেই অনেক অর্ডার থাকায় রোজার শুরুতে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক টেইলার্স।

এলিফেন্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা মার্কেটের স্মরণিকা লেডিস টেইলার্সে রোজার এক মাস আগে থেকেই বাড়তি অর্ডার আসতে শুরু করে। ফলে প্রথম রোজার পরই অর্ডার নেওয়া বন্ধ করা হয়।

এই দোকানের মালিক আবদুল হামিদ জানান, এবার কাজের অনেক অর্ডার পেলেও কারিগরের অভাবে তারা বিপাকে পড়েছেন।

“প্রচুর কাজ পেয়েও নিতে পারি নাই। আমাদের কারিগর কম, লোক পাচ্ছি না। আমরা অনেক ব্যবসা করতে পারতাম, কিন্তু ওয়ার্কারের অভাবে সেটা পারলাম না।”

এর পেছনে দুই কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, “যারা পুরনো আছে, কাজটা জানে, তাদের অনেকে করোনার মধ্যে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার কেউ কেউ দেশের বাইরে যেমন- দুবাই, সৌদি আরব চলে গেছে। ওখানে তো এই কাজের চাহিদা বেশি।”

হামিদের ভাষ্য, “এবার তিনি দুই লাখ টাকার মত কাজের অর্ডার নিয়েছেন, যা ২০১৯ সালের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ।”

এ মার্কেটের ফয়সাল মার্স্টার্স টেইলার্সে মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, ব্লাউজ, গাউন, টপস, ফ্রক তৈরি করা হয়।

দোকানের কর্ণধার ফয়সাল মিয়া বললেন, প্রথম দিকে তেমন কাজ না পেলেও পরে একসাথে অনেক কাজ পেয়েছেন। সেলাই কারিগরের সংকটের কারণে সেসব কাজের বড় অংশই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে তাকে।

পোশাক বানাতে টেইলার্স মালিকরা প্রধানত কাটিং মাস্টারের ওপর নির্ভর করেন। তিনি কাপড় কেটে দিলে কারিগররা তা সেলাই করেন।

ফয়সাল মিয়ার দাবি, সেলাই করার কারিগর কমে যাওয়ায় বাড়তি অর্ডার এলে কাটিং মাস্টারকে দিয়েই সে কাজ করাতে হচ্ছে। তাতে মূল কাজের ক্ষতি হচ্ছে, গুণতে হচ্ছে বাড়তি খরচ।

“একটা মাস্টারকে কারিগরের চেয়ে ডাবল টাকা দিতে হয়। কিন্তু এখন তাকে কাপড় সেলাই করতে পাঠাতে হচ্ছে কারখানায়। এটা লস না? কিন্তু আমার তো কাজ করাতে হবে। কারিগর থাকলে এতো টাকা যেত না, কাটিং মাস্টারকে দিয়ে সেলাইও করাতে হত না।”

এই পেশার ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করে ফয়সাল বলেন, “আমরা যখন কাজ শিখছি, তখন অনেকেই এটা শিখত। তখন শিক্ষার হার কম ছিল। এখন কম পড়াশুনা করলেও এসএসসি পাস করে। আর এসএসসি পাস করে কেউ সেলাই শিখতে আসে না।

“এ কারণে নতুন লোকের ঘাটতি আছে, পুরানরা ভালো সুযোগ পাইলে দেশের বাইরে চলে যায়। অনেক কারিগর লকডাউনের পরে বিদেশে চলে গেছে, এটা সারা দেশেই।”

বনানী সুপার মার্কেটের চিত্র একই। সেখানেও ঈদের আগ মুহূর্তে টেইলার্সগুলোতে কাজের ব্যস্ততা অনেক বেশি।

আল ফারুক টেইলার্সের কারিগর মো. জসিম জানান, ঈদের আগে সময় কম থাকায় অনেককেই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের।

“যেগুলো অর্ডার নিয়েছি, সেগুলো তো দিতে হবে। বেশি কাজ নিলে কোয়ালিটি খারাপ হয়। তাই আর অর্ডার নিচ্ছি না।”

মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, নারীদের পোশাকের দোকানগুলোতেই অর্ডার এসেছে বেশি। বনানীর টেইলার্সগুলোতে সুতি থ্রি-পিস ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা এবং জর্জেট বা অন্যান্য জামার মজুরি ১৫০০ থেকে থেকে ২ হাজার টাকা নেওয়া হয়।

এ মার্কেটের খোকন টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক্স ঈদ উপলক্ষে ৭ লাখ টাকার কাজ পেয়েছে, এর মধ্যে অর্ডার বেশি এসেছে সালোয়ার কামিজের।

দোকানের কর্ণধার খোকন মিয়া জানান, ১৮ বছরের দর্জি ব্যবসায় কারিগরের ‘এতো সংকট’ দেখেননি তিনি।

“এখন কারিগর একদম পাচ্ছি না, বিশেষ করে যারা সেলাই করে। আগে ঈদে বাড়তি লাভের আশায় হলেও অনেকে সেলাই করত। এবার এমন লোকই পাচ্ছি না।”

মিরপুরের সাধারণ দর্জি দোকানগুলোতে সুতি থ্রি পিস বানাতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, নিউ মার্কেট ও এলিফেন্ট রোডে ৫০০-৭০০ টাকা, বনানীতে ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা মজুরি গুণতে হচ্ছে। তুলনামূলক মজুরি কিছুটা কমের কারণে মিরপুরের দর্জিপাড়ায় গ্রাহকের ভিড় বেশি।

কঠিন সময় পেরিয়ে

আল ফারুক টেইলার্সের কারিগর মো. জসিম জানান, তাদের মজুরি নির্ভর করে কাজের ওপর।

“যতগুলা সালোয়ার-কামিজ সেলাই করব, সেই পরিমাণ টাকা আমরা পাব। কম করলে কম, বেশি করলে বেশি। তাই কাজ না থাকলে তো আমাদের বেতন নাই।”

কারিগরদের পেশা ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “করোনার সময় যখন লকডাউন ছিল, তখন তো কাটিং মাস্টাররাই কোনো কাজ পায় নাই। আমরা কাজ পাব কেমনে?

“এই পেশায় আয় না থাকায় তখন অনেকে অন্য ব্যবসা শুরু করছে। কেউ ফেরি করছে, তরকারি বিক্রি করছে, কেউ গার্মেন্টসে ঢুকে গেছে। কেউ বিদেশে চলে গেছে।”

রংধনু শপিং কমপ্লেক্সের রবি ফ্যাশন টেইলার্সে পাঁচ বছর ধরে কাজ করেন সেলাই কারিগর শামীম। গত দুই বছরে কাজ না থাকায় কঠিন সময় পার করতে হয়েছে তাকে।

“মহাজনের নিজেরই চলে না, আমাগো চালাইব কেমনে? তখন টুকটাক কাজ পাইলে মহাজনরাই কইরা ফেলছে। আমি কিছু দিন ইস্ত্রির দোকানে কাজ করছি, কারচুপির কাজ করছি।

“এইবার যখন কাজ আসতে শুরু করল, মহাজন আবার ডাকছে। ঈদের সিজনে এইবার অনেক কাজ আসছে, আমরাও কাজ পাচ্ছি। দিন-রাত কাজ করা লাগতাছে ঠিক, ইনকাম তো হচ্ছে।”

মহামারীর ধাক্কায় ঋণের বোঝা

মিরপুর ১২ নম্বরের রঙধনু শপিং কমপ্লেক্সের চারতলার পুরোটাই দর্জির দোকান। ঈদের কাজে সন্তুষ্ট হলেও মহামারীর ধাক্কায় ঋণের বোঝা এখনও টানতে হচ্ছে বলে জানান অনেকে।

গত ১৫ দিনে ভালো কাজ পেয়েছেন জানিয়ে রবি ফ্যাশন টেইলার্সের মালিক মাস্টার মো. সেলিম বলেন, “কোভিডে অনেক লস গেছে। সেজন্য ঋণ নিতে হয়েছে। সেটাই এখন কাটায় উঠতেছি।”

৩০ বছর ধরে এই পেশায় থাকা এ মার্কেটের নিউ ফ্যাশন টেইলার্সের পরিচালক জুলমত মাস্টার বলেন, “গত দুই বছরের ঈদের মত খারাপ অবস্থা জীবনে দেখি নাই। সেইটা পূরণ তো সম্ভব না। এখন হয়ত খেয়ে-পরে ভালো আছি।”

ঈদে বাড়তি লাভের আশায় ৫০-১০০ টাকা মজুরি বাড়ানোর কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “ঈদে কিছু তো লাভ করাই লাগে। সবকিছুর দাম বাড়ছে। গত দুইবছর তো রেট বাড়ে নাই, এখন বাড়ছে। দাম না বাড়ালে কারিগরদের নিয়ে চলব কেমনে?”

সংঘর্ষের প্রভাব নিউ মার্কেটে

এবার ঈদে ছেলেদের পোশাকের অর্ডার তুলনামূলকভাবে কম আসার কথা বলছেন দর্জিরা।

নিউ মার্কেটের বশিরউদ্দিন টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক্সে পাঞ্জাবি-পায়জামা, কাবলি, শেরওয়ানি, শার্ট-প্যান্ট, স্যুট তৈরি করা হয়। ঈদে অর্ডার বেশি এসেছে কাবুলি সেট ও পাঞ্জাবি-পায়জামার।

দোকানের মালিক বশির উদ্দিন বলেন, “এবার অর্ডার কিছুটা কম। শেষ সময়ে কিছু আসতেছে। এখন তো আমাদের হাতেও সময় নাই। অর্ডার নিতে পারতেছি না।”

নিউ মার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী ও দোকানকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দুই-তিনদিন মার্কেট বন্ধ থাকায় গ্রাহক কম আসার পাশাপাশি কাজেও অসুবিধা হওয়ার কথা জানান তিনি।

‘ব্র্যান্ডের টেইলার্সগুলোতে অর্ডার কম’

ব্র্যান্ডের টেইলার্সগুলোতে আশানুরুপ অর্ডার না পাওয়ার কথা বলছেন শাখা ব্যবস্থাপকরা।

ছেলেদের পোশাক তৈরির ব্র্যান্ড টপ টেইনের এলিফ্যান্ট রোড শাখায় এবার পাঞ্জাবির অর্ডার বেশি এসেছে। ৬০০ টাকায় পাঞ্জাবি, ৫০০ টাকায় শার্ট, ৬৫০ টাকায় প্যান্ট বানিয়ে দিচ্ছে টপ টেইন।

শাখা ব্যবস্থাপক শুভ দেবনাথ বলেন, “অন্যবারের তুলনায় অর্ডার কম এবার। তবে আমরা শার্ট, প্যান্ট নেওয়া মোটামুটি বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ এখন তো হাতে সময় নেই।”

ফিট এলিগেন্সের মিরপুর ১০ নম্বরের শাখায় ঈদ উপলক্ষে তেমন কাজ আসেনি।

এখানকার শাখা ব্যবস্থাপক মো. শোয়েব জানান, তাদের দোকানে স্যুট বানানোর চাহিদা বেশি। শার্ট-প্যান্ট বানানো হলেও এবার ঈদে তেমন অর্ডার পাননি।

“আমাদের এখানে প্রোগ্রাম বেইজড কাজ বেশি হয়। আমরা রেডিমেইড পাঞ্জাবি বিক্রি করি। শার্ট-প্যান্টের তেমন বাড়তি অর্ডার পাইনি এবার।

“আমাদের ১২টা ব্র্যাঞ্চের তুলনায় মিরপুরে সেল কম। এখানে মধ্যবিত্ত মানুষ বেশি, আবার গাড়ি রাখা যায় না। এসব কারণেও কাস্টমাররা কম আসে।”